দুই দিনের জন্য ঢাকায় এসে ১০ বছর ছিলেন, গানেই চলে রেজাউলের সংসার
রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভা কার্যালয়ের পাশ দিয়ে গেছে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক। ব্যস্ত এই মহাসড়ক দিয়ে চলছে গাড়ি। আছে গাড়ির হর্নসহ নানা শব্দ। মহাসড়কের পাশে বসে হাত দিয়ে একটি গামলা বাজিয়ে গান শোনাচ্ছেন এক ব্যক্তি। পথচারী ও আশপাশের লোকজন গান শুনে খুশি হয়ে যা দেন, তা দিয়ে চলে গায়েনের সংসার।
এই গায়েনের নাম মো. শেখ রেজাউল করিম (৪১)। রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভা এলাকার বাখরাবাদ দক্ষিণপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবার নাম মো. আন্তাজ আলী শেখ। সংসারে তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রেজাউল সাত বছর বয়স থেকে চোখে দেখেন না।
২৭ নভেম্বর বিকেলে কাটাখালী পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে মহাসড়কের পাশে বসে রেজাউল গান গাইছিলেন, আর তালে তালে গামলা বাজাচ্ছিলেন। মনির খান, আসিফ আকবর, রবি চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, মমতাজ, জেমস, বিপ্লবসহ বিভিন্ন শিল্পীর জনপ্রিয় গান তিনি গেয়ে থাকেন। গান শেষে মহাসড়কের পাশে একটি চায়ের দোকানে রেজাউলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আমার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছেন, কিন্তু সুন্দর একটি কণ্ঠ দিয়েছেন। এ কারণে কারও কাছে হাত পাতি না। গানই আমার জীবনের সঙ্গী, গানেই চলে সংসার।’
রেজাউল করিম জানালেন, তাঁর কষ্টের জীবন। সাত বছর বয়স পর্যন্ত অন্য সাধারণ শিশুর মতো তিনিও চোখে দেখতেন। হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে চোখ নষ্ট হয়ে অন্ধ হয়ে যান।
রেজাউলের চার ভাইয়ের অভাবের সংসার। ভাইদের মধ্যে তিনি মেজ। ভিটেবাড়ি ছাড়া তাঁদের আর কিছুই নেই। রেজাউল অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বাড়ির টুকটাক কাজ করতেন। গানের প্রতি আগ্রহ থাকায় ফিতার ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতেন, আর গান মুখস্থ করে নিজে গেয়ে রেকর্ড করে শুনতেন। ২০০৫ সালে রাজশাহীতে ক্লোজআপ ওয়ানের একটি অডিশনে ডাক পান। অডিশনে দুটি গান গাওয়ার সুযোগ হয় তাঁর। অডিশনের এক বিচারক তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে সামনে তিনি ভালো করবেন বলে উৎসাহ দেন।
রেজাউল বলেন, ‘আমার জন্ম ১৯৮৩ সালে। পরিবারের মধ্যেই কষ্ট করে বড় হয়েছি। ২০০১ সালের দিকে রাজশাহী চিনিকলের চিনি রাজশাহীর বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। কিন্তু একটা সময় আমার কাছে মনে হয়েছে, গানটাই আমার জীবন। তাই পরে গানের কাছেই ফিরে আসি। রাজশাহীর দুটি সংগীত বিদ্যালয়ে দুই উস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছি। এর পর থেকে আর গান ছাড়িনি। ঢাকায় ১০ বছরের মতো গান গেয়েছি। আর রাজশাহীতেও ১০ বছর ধরে গান গাইছি। যত দিন বাঁচব, গান গেয়েই যাব। এটা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।’
রেজাউল করিম হাতে একটি লাঠি নিয়ে চলাচল করেন। লাঠি দিয়ে ঠক ঠক করে আন্দাজ করে পথ চলেন। তিনি বলেন, যে এলাকায় একবার যান, সেই রাস্তা আর ভোলেন না। শব্দ শুনেই বুঝতে পারেন আর পথ চলতে পারেন। এমনকি মাঝেমধ্যে রাস্তাও পার হন একা একা। ঢাকায় ১০ বছর তিনি একাই চলেছেন।
রেজাউলের বাবা মারা যান ২০১৩ সালে। তখন তিনি রাজশাহীতে ফিরে আসেন। পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে আবার ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে আবার রাজশাহীতে ফেরেন ২০১৫ সালে। এর পর থেকেই রাজশাহীতে পথশিল্পী হিসেবে গান গেয়ে আসছেন।
কণ্ঠশিল্পী হওয়ার স্বপ্নে ঢাকায়
রেজাউল রাজশাহীতে কারও কাছে শুনেছিলেন যে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র উপস্থাপক হানিফ সংকেত গ্রামের শিল্পীদের মূল্যায়ন করেন। অবহেলিত শিল্পীদের তুলে এনে বড় শিল্পী বানান। তাই বড় কণ্ঠশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন ২০০৫ সালে। হানিফ সংকেতের খোঁজে ঢাকার মিরপুর, গাবতলী ও রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে গিয়ে বসে থেকেছেন। কিন্তু তাঁর দেখা পাননি।
ঢাকার জীবন নিয়ে রেজাউল বলেন, দুই দিনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু থেকেছেন একেবারে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, মানে ১০ বছর। এই সময়ে ঢাকায় মিরপুরে একটি বস্তিতে তিনি ভাড়া থাকতেন। মিরপুর চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে গান গাইতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। মানুষ গান শুনে যে খুশি হতেন, তা মানুষের কথাবার্তার মাধ্যমে বুঝতে পারতেন।
রেজাউলের বাবা মারা যান ২০১৩ সালে। তখন তিনি রাজশাহীতে ফিরে আসেন। পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে আবার ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে আবার রাজশাহীতে ফেরেন ২০১৫ সালে। এর পর থেকেই রাজশাহীতে পথশিল্পী হিসেবে গান গেয়ে আসছেন।
কাটাখালীর যে চায়ের দোকানে বসে কথা হয় রেজাউলের সঙ্গে, সেই চায়ের দোকানি মো. বাবলু বললেন, জীবনে এত কষ্ট করা রেজাউলের মতো মানুষ কমই দেখেছেন। এখানে এসে চা খেয়ে দাম দিয়ে যান। কারও দেওয়া কিছু নেন না। নিজের মতো করে গান করেন। তাতে কেউ কিছু দিলে, সেই টাকা নেন। খুব সৎভাবে জীবন যাপন করেন তিনি।
রেজাউলের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। বড় ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলেটি স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। রেজাউল বলেন, ‘আমার জীবন খুব কষ্টের এবং অনেক ঘটনাবহুল। জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করিনি। খুব বেশি বিপদেও পড়িনি। ইচ্ছে আছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাব। তারা মানুষের মতো মানুষ হবে। আর আমি গান গেয়ে গেয়ে হয় তো একদিন মারা যাব।’