বৃহস্পতিবার রাতের অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা

লালমনিরহাটে এক যুগ ধরে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করে আসছে ‘নদী ভাঙ্গা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন
ছবি: প্রথম আলো

‘আগের দিন মনে কইরা লাভ নাই। সব গেছে নদীত। এখন স্টেশনে থাকি। শহরে ভিক্ষা করি। নদী ভাঙ্গা পরিষদ থাইকা সপ্তাহের প্রতি বিষুধবার (বৃহস্পতিবার) রাইতে ভালো খাবার পাই। এই জন্য বিষুধবার রাইত হইলেই এইখানে আসি।’

সম্প্রতি কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ভাঙনের শিকার নুরুন্নবী মিয়া (৬০)।

এভাবে তাঁর মতো নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো ছিন্নমূল, দরিদ্র এবং শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ প্রতি বৃহস্পতিবার রাতের অপেক্ষায় থাকেন। কারণ, এই রাতে লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ‘নদী ভাঙ্গা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন দুস্থ মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার (বিশেষ করে খিচুড়ি) বিতরণ করে। লালমনিরহাট রেলস্টেশন এলাকায় থাকা কোনো ছিন্নমূল মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাঁকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা এবং মারা গেলে দাফন–কাফনের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও পালন করে নদী ভাঙ্গা পরিষদ। প্রায় এক যুগ ধরে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সংগঠনটি।

শহরের রেলওয়ে বাবু পাড়ার পরিত্যক্ত বাসায় থাকেন কমল মিয়া (৫৫)। আগে রিকশা চালাতেন। এখন কাজকর্ম করার শক্তি নেই শরীরে। কমল মিয়া বলেন, ‘এখন রিকশা চালাইতে পারি না। কয়েক বছর থাইকা বিষুধবার রাইতে স্টেশনে যাই। সপ্তায় অন্তত একটা দিন পেট ভইরা খাইতে পারি।’

নদী ভাঙ্গা পরিষদের সভাপতি শামীম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান এবং প্রচার সম্পাদক ফজলুল হক জানিয়েছেন, তাঁদের নিজস্ব কোনো তহবিল নেই। আগ্রহী বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন থেকে অর্থ ও খাদ্য উপকরণ সংগ্রহ করেন তাঁরা। এরপর সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে খিচুড়ি রান্না করেন—যা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে বিতরণ করা হয়। শহরের অনেক বাসা থেকে নারীরা মুষ্টির চাল দিয়ে যান, বাগানের শাকসবজি দিয়ে যান। শহরের গোশলা বাজারের সবজি ব্যবসায়ীরাও কখনো কখনো সবজি দিয়ে যান।

তাঁরা আরও জানিয়েছেন, লালমনিরহাট জেলার প্রধান তিনটি নদী তিস্তা, ধরলা ও রতনাইয়ের ভাঙনের শিকার হয়ে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাঁদের অনেকে রেলস্টেশন, বাস স্টেশন, রিকশাস্ট্যান্ডে বা শহরের কলোনি ও দোকানের বারান্দায় রাত কাটান। বয়সের কারণে অনেকে কাজ করতে পারেন না। পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা অনেক প্রবীণের খোঁজ নেন না। অনেকে আবার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। এমন অসহায় মানুষদের কথা ভেবে তাঁরা এই সংগঠন করেছেন।

ছিন্নমূল মানুষের জন্য খিচুড়ি রান্না করছেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা
ছবি: প্রথম আলো

লালমনিরহাটের সংবাদকর্মী ও নদী ভাঙ্গা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এম এ হান্নান বলেন, শহরের বিভিন্ন এলাকার দুই শ থেকে তিন শ দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে লালমনিরহাট রেলস্টেশন এলাকায় আসেন। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেন।

লালমনিরহাট শহরের থানাপাড়ায় বাড়ি বিচারপতি মো. ইকবাল কবীরের। আজ শনিবার দুপুরে মুঠোফোন তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার প্রয়াত মা ও বাবার আত্মার শান্তি কামনায় নদী ভাঙ্গা পরিষদকে একাধিকবার আর্থিকভাবে সহায়তা করেছি—ওই টাকা দিয়ে তাঁরা দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন।’

লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদও বিভিন্ন সময়ে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন সংগঠনটিকে। তিনি বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের রমজান মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁদের আর্থিকভাবে সহায়তা করেছি।’

লালমনিরহাট শহরের উচাটারি এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী কাউছার ঢালী (৩৫) বলেন, ‘আমি ও আমার ভাই অপু ঢালী নদী ভাঙ্গা পরিষদকে সহায়তা করি। তাঁরা ভালো কাজ করতেছে।’

নদী ভাঙ্গা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, প্রতি বৃহস্পতিবার ৩৫ থেকে ৪০ কেজি চালের সবজি খিচুড়ি এবং মাসে অন্তত একবার মুরগি বা খাসির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি বা খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হয়।

নদী ভাঙ্গা পরিষদের সদস্য স্বেচ্ছাসেবকেরা এক যুগ ধরে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র কাজ করে চলেছেন উল্লেখ করে লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি নিজেও একাধিকবার সহায়তার মাধ্যমে তাঁদের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি।’