অদম্য মেধাবী-২০২৫—৮
স্বপ্নই দিয়েছে শক্তি, এসেছে সাফল্য
নতুন পথচলায় তাদের সামনে বড় প্রশ্ন—ভবিষ্যতের পড়ালেখার খরচ কীভাবে মেটানো যাবে?
সংসারে সীমাহীন অভাব। কারও বাবার অল্প আয়। কারও বাবাহারা জীবনে ভরসা হয়ে দাঁড়ান গৃহিণী মা। দুবেলা খাবারের টানাটানি, পড়াশোনার খরচ জোগাড়ের অনিশ্চয়তা। এসবের ভেতর দিয়েই তারা স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেছে।
ঝিনাইদহের জাকিয়া তাবাচ্ছুম, বরিশালের তিশা আক্তার, রাজশাহীর মুশফিকা খানম আর সুনামগঞ্জের আবদুল্লাহ শেখ এমন সংগ্রাম করেই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তবে নতুন পথচলায় তাদের সামনে এখনো রয়ে গেছে অনিশ্চয়তার বড় প্রশ্ন—ভবিষ্যতের পড়ালেখার খরচ কীভাবে মেটানো যাবে?
পড়ার কথা বলতে হয়নি জাকিয়াকে
জাকিয়া তাবাচ্ছুমের ছোট থেকেই ইচ্ছা বড় হয়ে প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা করতে পারেনি। মানবিক বিভাগ নিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাকি দিনগুলো কীভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যাবে, তা নিয়ে চিন্তিত জাকিয়া ও তার পরিবার।
জাকিয়া ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার খয়েরতলা গ্রামের জিয়াউর রহমানের মেয়ে। জিয়াউর রহমান বাইসাইকেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা করেন। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে জাকিয়া সবার বড়।
জিয়াউর রহমান জানান, তিনি যা আয় করেন তা দিয়ে কোনোমতে পাঁচজনের সংসার চলে। ছোটবেলা থেকেই জাকিয়াকে কখনো পড়ার কথা বলতে হয়নি। মেয়ে এবার কালীগঞ্জ শহরের ছলিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। জাকিয়ার মা শিখা খাতুন জানান, মেয়ে চাইছে ভালোভাবে পড়ালেখা করে সরকারি কর্মকর্তা হবে। তার বাবার সামর্থ্য নেই মেয়েকে পড়ানোর খরচ জোগাড়ের।
জাকিয়ার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিদৌরা আক্তার জানান, সবাই এগিয়ে এলে মেয়েটি একদিন ভালো কিছু করতে পারবে।
বড় অর্জনে বড় দুশ্চিন্তা
ছোটবেলা থেকেই সংসারে অভাব-অনটন। বাবা ইউসুফ হাওলাদার প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার বান্ডিল কাঁধে নেন। নগরের গলিঘুপচি ঘুরে পত্রিকা বিলি করে যা পান, তা দিয়ে চলে পাঁচজনের সংসার। মাসের শেষে ঘরভাড়া, খাওয়া-পরার খরচ মিটিয়ে তাঁদের জীবনে অবশিষ্ট থাকে শুধু কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস। তবু সব অভাব-অভিযোগ ছাপিয়ে বড় মেয়ে তিশা আক্তার এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
তিশাদের পরিবার বরিশাল নগরের সাগরদি এলাকার একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকে। তিশা দুই বোন-এক ভাইয়ের মধ্যে বড়। মেজ বোন তানজিলা বাক্প্রতিবন্ধী। একমাত্র ভাই রেদওয়ান প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। সংসার খরচের টানাটানি, তবু মা–বাবা চেষ্টা করেছেন মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে।
তিশার বাবা ইউসুফ হাওলাদার ও মা রিমা বেগমের কথায় বোঝা গেল এই ফল তাঁদের কাছে কত বড় অর্জন, আবার কত বড় দুশ্চিন্তার। ইউসুফ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘মেয়েটা অনেক কষ্ট করে পড়েছে। নিজের চেষ্টায় এত ভালো ফল করেছে। এখন কীভাবে মেয়েটাকে কলেজে পড়াব, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।’
তিশার স্বপ্ন নার্স হয়ে অসুস্থ মানুষের সেবা করা। কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের পথে এত বাধা পেরোতে হবে ভেবে, পরিবারের দৈন্য এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিশার মা রিমা বেগমের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। বলেন, ‘গরিবের জীবন বড়ই কষ্টের। ভালো করলেও কষ্ট, মন্দ করলেও কষ্ট!’
মায়ের হাঁস–মুরগি পালনের টাকায় লেখাপড়া
বাবার মৃত্যুর পর মুশফিকা খানমের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে থেমে যায়নি সে। মায়ের সাহস আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। মুশফিকা রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার আক্কেলপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। যদিও পড়েছে সাফিক্স প্রি-ক্যাডেট কিন্ডারগার্টেনে।
বাগমারা গ্রামের আবদুল মান্নানের একমাত্র মেয়ে মুশফিকা। বাবা সামান্য বেতনের চাকরি করতেন। তিনি ২০২১ সালে মারা যাওয়ার পর সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। সামর্থ্য না থাকার পরও মা রাহামা বিবি মেয়েকে সাহস দেন। এগিয়ে আসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি বইপুস্তকও সরবরাহ করেন। অন্য শিক্ষকেরাও এগিয়ে আসেন।
সাফিক্স প্রি-ক্যাডেট কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক জাকিরুল ইসলাম বলেন, মুশফিকা খানমের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে কোনো বেতন নেওয়া হয়নি। তাকে বই–খাতা সরবরাহ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠান থেকে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি না থাকায় পাশের এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
রাহামা বিবি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে বাড়িতে হাঁস–মুরগি পালন করে লেখাপড়ার খরচ বহন করছি। রাজশাহী শহরে রেখে লেখাপড়া শেখানোর আগ্রহ রয়েছে। তবে টাকার অভাবে পারব কি না, এ নিয়ে চিন্তায় আছি।’
মুশফিকা খানম বলে, ‘আশা করি সামনে আরও ভালো ফল করব। টাকার অভাবে তা পারব, কি না জানি না।’
লজিং থেকে পড়ালেখা আবদুল্লাহ শেখের
বাবা দুদু মিয়া মারা গেছেন ২০১৬ সালে। মা খুকু মনি গৃহিণী। পারিবারিক সহায়–সম্পদ বলতে আট শতক ভিটেবাড়ি ও টিনের একটি ঘর। পরিবারের উপার্জনশীল কোনো ব্যক্তি না থাকায় স্বজনদের সহায়তা ও অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া চালিয়ে আসছিল আবদুল্লাহ শেখ।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। তার বাড়ি উপজেলার চকিয়াচাপুর গ্রামে।
খুকু মনি জানান, তাঁর পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ৯ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। সংসারের আয়–উপার্জনশীল ব্যক্তি নেই। জমিজমা বলতে বাড়ির আট শতক ভিটেটুকু। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবদুল্লাহ শেখ সর্বকনিষ্ঠ। বড় ছেলে আলী আমজাদ গত বছরে হেফজ সম্পন্ন করেছে।
ছেলেদের নিয়ে সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে খুকু মনি বলেন, ‘আমি নিজেই মেয়েদের, জামাইদের বাসায় বাসায় থাকছি। দুই ছেলে তাঁদের ভগ্নিপতি ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় অন্যের বাড়িত লজিং থাইক্যা লেখাপড়া করছে। আমার স্বপ্ন, ছেলেডা লেখাপড়া কইরা একদিন ডাক্তার অইব, মাইনষের সেবা করব।’
বাদশাগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান বলেন, ‘মেধাবী ছাত্র আবদুল্লাহ শেখকে সাধ্যমতো সহায়তা করা হয়েছে। সে অত্যন্ত মেধাবী। লেখাপড়া করার সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে সে অবশ্যই ভালো করবে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝিনাইদহ ও বরিশাল এবং প্রতিনিধি, বাগমারা, রাজশাহী ও ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ]