অধিগ্রহণে বেশি টাকা পেতে ১২ ঘর নির্মাণ, শেষে নিরাশ আ.লীগ নেতা

খুলনা সিটি বাইপাস সড়কের লবণচরা থানা এলাকায় আধা–পাকা ১২টি ঘর নির্মাণ করেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শেখ আবেদ আলীছবি: প্রথম আলো

ফাঁকা জায়গায় পর পর আধা–পাকা ১২টি ঘর। টিনের ঘরগুলোর প্রতিটিতে তিন থেকে চারটি কক্ষ। রয়েছে শৌচাগার ও রান্নাঘর। প্লাস্টার করা ঘরগুলোর কোনোটিতেই রং করা নেই। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের মতো দেখতে এসব ঘরের দরজা-জানালাও ততটা মজবুত নয়। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের খোলবাড়িয়া মৌজার ফাঁকা জায়গায় ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন শেখ আবেদ আলী।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাঁর ওই জমি অধিগ্রহণ করার সম্ভাবনা ছিল। তাই অধিগ্রহণের টাকা বেশি পরিমাণে পেতে তড়িঘড়ি ঘরগুলো বানিয়েছিলেন তিনি।

এসব ঘরে বিনা মূল্য সাতটি পরিবারকে থাকতে দিচ্ছেন আবেদ আলী। জমি অধিগ্রহণের তালিকা থেকে এলাকাটি বাদ পড়ায় কাজে আসছে না তাঁর কৌশল

আবেদ আলী মূলত আবাসন ব্যবসায়ী। তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগে তাঁর কোনো পদ নেই। তবে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, আবেদ আলী ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। তিনি গোপালগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতির সভাপতি।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, আবেদ আলীর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত গুলজান সিটির জমিতে শেখ হাসিনা মেডিকেল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। অধিগ্রহণের আওতায় আনা বেশির ভাগ জমিই বিলান শ্রেণির। ওই ধরনের জমির মূল্য কম। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বাস্তুভিটা করা ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য গত বছর ঘরগুলো নির্মাণ করেন আবেদ আলী।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই জমিসহ আশপাশের আরও ১০০ একর জমি ওই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন মেলেনি। এ কারণে ঘর নির্মাণ করা জমিটি অধিগ্রহণের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

খুলনা নগরের নিরালা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী কার্যালয়টিও আবেদ আলীর নির্মাণাধীন ভবনে অবস্থিত।

অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ঘরগুলো নির্মাণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয় বলে দাবি করেন শেখ আবেদ আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমির মালিক তিনিসহ আরও কয়েকজন। ওই এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব কাজের শ্রমিকদের ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছরের প্রথম দিকে সেখানে শ্রমিকেরা ছিলেন। পরে তাঁরা ছেড়ে দিলে ফাঁকা পড়ে থাকা ঘরগুলো বিনা পয়সায় দরিদ্র মানুষদের থাকতে দেওয়া হয়।

এসব ঘরে সাতটি পরিবারকে বিনা মূল্য থাকতে দেওয়া হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রার মো. আবদুর রউব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ একর জমির কথা বলেছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে, ৫০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

খুলনা সিটি বাইপাস সড়কের লবণচরা থানার পাশেই শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত জমি। লবণচরা থানার সামনের ইটের ও মাটির প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কটি শেষ হয়েছে আবেদ আলীর জমিতে। আশপাশে তেমন কোনো বাড়ি নেই। ওই জমির পরই নির্মাণাধীন খুলনা-মোংলা রেললাইন।

গত রোববার বিকেলে ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ১২টি ঘরের মধ্যে অধিকাংশই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো কোনো ঘরে দরজা-জানালাও নেই। লম্বা আকৃতির ঘরগুলোতে রয়েছে তিন থেকে চারটি করে কক্ষ। এমন চারটি ঘরে বাস করছে সাতটি পরিবার। তবে পরিবারগুলোকে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। একটু দূর থেকে বিদ্যুৎ লাইন টানা হয়েছে। সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে পানির।

সাত মাস আগে ১২টি ঘরের একটিতে পরিবার নিয়ে উঠেছেন রাকিবা বেগম নামের এক নারী। তাঁর স্বামী রেজাউল শেখ রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করেন। রাকিবা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ঘরে বিনা ভাড়ায় থাকছেন। ওঠার সময় বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা ছিল না। দুই মাস কষ্ট করতে হয়েছে। পরে আবেদ পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন। এখান থেকে শহর অনেকটা দূরে। কিন্তু বিনা ভাড়ায় থাকার সুবিধার কারণে তাঁরা সেখানে থাকছেন।

পাশের ঘরে থাকেন রনজিতা বেগম নামের এক নারী। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীও রেজাউলের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বিনা মূল্যে থাকা যাচ্ছে জানতে পেরে তেরখাদা থেকে ডিসেম্বর মাসে পরিবারসহ খুলনায় এসেছেন।

খুলনায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আলোচনা শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই সময় থেকেই লবণচরা থানার পাশের ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তারা ওই স্থান পরিদর্শনও করেন। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ‘শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, খুলনা-২০২০’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল উপাচার্য নিয়োগের পর জমি চূড়ান্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খোলাবাড়িয়া মৌজায় ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেন খুলনার জেলা প্রশাসক। সেইভাবেই কার্যক্রম চলছিল। হঠাৎ করে গত ২৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ একর জমি চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। গত ৬ ডিসেম্বর ওই ৫০ একর জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) মোছা. শাহানাজ পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রথমে ১০০ একরের মতো জমি অধিগ্রহণের কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ একরের কাগজপত্র ও সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ মূল্য জানানোর জন্য চিঠি দিয়েছে। সেই হিসেবে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ তৈরির কাজ চলছে।