তানসেনের নৌকা ঠেকাতে জিয়াউলের ঈগলে এককাট্টা আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটি অংশ

এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন ও জিয়াউল হক মোল্লাছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লার (ঈগল প্রতীক) পক্ষে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ কাজ করছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির অনেক নেতা-কর্মী তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নেমেছেন। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন এই আসনে জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন (নৌকা)।

জিয়াউল হক মোল্লা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নির্বাহী সদস্য। তিনি দলটি থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রথমে কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজকে নৌকার মনোনয়ন দিয়েছিল। পরে আসন ভাগাভাগি হলে জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিমকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। রেজাউল দলীয় প্রতীক মশালের বদলে নৌকা নিয়ে লড়ছেন। তবে এই নৌকার সঙ্গে কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

জিয়াউল হক মোল্লা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ সব পক্ষ ঈগলের সঙ্গে আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেকে প্রকাশ্যে, অনেকে ভেতরে–ভেতরে আমাকে জেতাতে কাজ করছেন। প্রশাসন থেকে যথেষ্ট সহযোগিতাও পাচ্ছি।’

বুধবার কাহালু উপজেলার নির্বাচনী এলাকার অন্তত ২০ জন ভোটার জানান, বিএনপির দায়িত্বশীল কিছু নেতা বাদে অধিকাংশ নেতা-কর্মী জিয়াউল হক মোল্লার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। এ কারণে বিএনপি থেকে ইতিমধ্যে দুই উপজেলার ১৪ নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। পাশাপাশি ভেতরে–ভেতরে কাহালু ও নন্দীগ্রাম আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ জিয়াউলকে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি তাঁর পক্ষে কেন্দ্রে ভোটার টানতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও মাঠে সরব। জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিমের নৌকার পক্ষে কাজ করায় নন্দীগ্রাম পৌর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।

নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী রেজাউল করিমের নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে কোনো দিন সম্মান পাননি, কোনো কাজে গেলে মূল্যায়নও হয়নি। তবু আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো করে নৌকার প্রচারণা চালাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত ১২ জন ভোটার দাবি করেন, জিয়াউল হক মোল্লার সঙ্গে সরকারের গোপন সমঝোতা হয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নৌকার বদলে ঈগলে ঝুঁকেছেন। প্রশাসনও অন্যদের তুলনায় তাঁকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে এ কে এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের একটি সংস্থা ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতাতে কাজ করছে—এমন অপপ্রচার চালিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা ভোটারদের পক্ষে নেওয়ার কৌশল। ভোট অত্যন্ত স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে। এসব অপপ্রচার চালিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা সফল হবে না।

আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার বিপক্ষে কাজ করার বিষয়ে এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রথমে কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির হাতে নৌকা দিয়েছিল দল। পরে ১৪ দল থেকে নৌকা আমাকে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের শিবিরে মান–অভিমান থাকবেই। দু-একজন বিচ্ছিন্নভাবে নৌকার বিপক্ষে যেতেই পারেন। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা আমার সঙ্গেই আছেন।’
হেলাল উদ্দিন কবিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, রেজাউল করিম দুই দফা সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু ‘কমিশন’ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কোনো কাজ করেননি। তিনি নৌকার প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি।

দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জিয়াউল হক মোল্লার বাবা আজিজুল হক মোল্লা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে তিনি মারা গেলে জিয়াউল হক মোল্লা উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে জয়ী হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। ২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলে সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হন জিয়াউল হক মোল্লা। এরপর বিএনপিতে তিনি ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে মোস্তফা আলীকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের খসড়া তালিকায় তিনি ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বদলে মোশারফ হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

ভোটারদের ভাষ্য, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলটির একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। জিয়াউল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ায় বিএনপি ও  সহযোগী সংগঠনের ১৪ নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন।

গত ১১ ডিসেম্বর কাহালু উপজেলার তিনদিঘি এলাকায় জিয়াউল হক মোল্লার ওপর হামলা হয়। এ সময় নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিয়াউল হক মোল্লা বাদী হয়ে ওই দিনই কাহালু থানায় বিএনপির ৪২ নেতা-কর্মীকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। পরে পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে।

মামলার তিন দিনের মাথায় ১৪ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কাহালু উপজেলা বিএনপির ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদর থেকে এবং উপজেলা বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে শেরপুর উপজেলার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের সন্ধান চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেও কাজ না হলে ২৬ ডিসেম্বর হাইকোর্টে পৃথক রিট করা হয়। এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে ৪ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে ২৭ ডিসেম্বর নির্দেশ দেন বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ২৮ ডিসেম্বর বাড়ি ফেরেন কাহালু উপজেলা বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। ২৯ ডিসেম্বর বাড়ি ফেরেন বিএনপির নেতা দেলোয়ার হোসেন। এরপর সাংবাদিকেরা তাঁদের বাড়িতে ভিড় করলে দুজনই আত্মগোপনে চলে যান।

দুই নেতাকে তুলে নেওয়ার নেপথ্যে জিয়াউল হক মোল্লাকে দায়ী করে এলাকায় পোস্টারিং করা হয়েছে। এ বিষয়ে জিয়াউল হক মোল্লা  বলেন, ‘বিএনপির দুই নেতাকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় আমার কোনো হাত নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা কয়েকজন আমার ওপর দোষ চাপিয়ে এলাকায় পোস্টারিং করেছে।’ গত ১৬ ডিসেম্বর জিয়াউল হক মোল্লার মালিকানাধীন একটি ফিলিং স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপির ৮-১০ জন নেতাকে আসামি করে মামলা হয়। পুলিশ ইতিমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

এদিকে ‘যাঁরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না, তাঁদের জন্য ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে’—নির্বাচনী সভায় এমন বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন জিয়াউল হক মোল্লা। পরে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি তাঁকে সতর্ক করে।

এ আসনে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাহীন মোস্তফা কামাল (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম (ডাব), গণতন্ত্রী পার্টির প্রার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম (কবুতর) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুশফিকুর রহমান (ট্রাক)।