বিদেশে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের ঝাড়ু

আগানগর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঝাড়ুপল্লিতে ঝাড়ুর ছোট-বড় কারখানা ও দোকান রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক মানুষের।

ঝাড়ুপল্লিতে ঝাড়ু বানানোয় ব্যস্ত কারিগর। সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরসংলগ্ন কেরানীগঞ্জের আগানগর কেচি শাহ ডক এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ঝাড়ুর অসংখ্য কারখানা ও দোকান। শলা ও ঝাড়ু ফুল দিয়ে বানানো সেখানকার ঝাড়ু দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও যাচ্ছে। এতে ব্যবসার পরিধি বাড়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরসংলগ্ন আগানগর কেচি শাহ ডক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঝাড়ু তৈরির কারখানা ও দোকানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ঝাড়ুপল্লি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই পল্লিতে ঝাড়ুর অর্ধশতাধিক ছোট–বড় কারখানা ও দোকান রয়েছে।

বাদশা মিয়া ঝাড়ু ঘর, মেসার্স সেলিম স্টোর, রাতুল কুটির, আরিফ কুটির শিল্প ও আরাফাত ঝাড়ু ঘরের সামনে দেখা যায় ঝাড়ুর পসরা। দোকানগুলোতে খুচরা ও পাইকারি দরে ঝাড়ু বিক্রি করা হচ্ছে।

ঝাড়ু বানানোর কারিগর সরোয়ার হোসেন (৫৮) বলেন, ‘প্রায় ৩৮ বছর ধরে আমি ঝাড়ু বানাচ্ছি। আমিসহ আরও তিন কর্মচারী ঝাড়ু তৈরির কাজ করছি। আগে আমি একা কাজ করতাম। এখন একটি বড় ঘর ভাড়া নিয়েছি। এখানে ঝাড়ু তৈরি করে বিক্রি করছি।’

ঝাড়ু ব্যবসায়ীরা জানান, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙামাটিসহ পাহাড়ি এলাকা থেকে ঝাড়ু ফুল কিনে আনেন তাঁরা। এ ছাড়া মিয়ানমার ও ভারত থেকে ঝাড়ুর ফুল আমদানি করা হয়। আর শলা আনা হয় বরিশাল অঞ্চল থেকে।

আগানগর কেচি শাহ ডক এলাকায় ঝাড়ু বানানোর শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান খাদেজা ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ২০ বছর ধরে তিনি এখানে ঝাড়ুর ব্যবসা করছেন। তাঁর হিসাবমতে ওই এলাকায় ঝাড়ুর অর্ধশতাধিক দোকান ও কারখানা রয়েছে। মিজানুর বলেন, ‘আমি দরপত্রের মাধ্যম ঢাকা সিটি করেপারেশনসহ পৌরসভাগুলোতে পাইকারি দরে ফুল ও শলার ঝাড়ু বিক্রি করছি। মাঝে মধ্যে দুবাই, ইউরোপ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি করি। দিন দিন ঝাড়ুর চাহিদা বাড়ছে। পাইকারেরা একসঙ্গে ৫০ থেকে ৭০ হাজার ঝাড়ু কিনে নিয়ে যান।’

কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানাগুলোতে শলা ও ফুলের ঝাড়ু তিন ধরনের হয়—ভিআইপি, উন্নত ও সাধারণ মানের। ভিআইপি শলার ঝাড়ু পাইকারি দরে ১০০টির দাম ১০ হাজার টাকা, একই মানের ফুলের ঝাড়ু ১০০টির দাম ১৪ হাজার টাকা। উন্নত মানের শলার ১০০টি ঝাড়ুর দাম ৮ হাজার টাকা, এই মানের ফুলের ঝাড়ুর ১০০টির দাম ১০ হাজার টাকা। আর সাধারণ মানের শলার ১০০টি ঝাড়ুর দাম ৪ হাজার টাকা, ফুলের ঝাড়ুর দাম ৬ হাজার টাকা।

ফাইভ স্টার ট্রেডার্সের পরিচালক আল আমিন বলেন, ‘আমাদের এখানে তৈরি করা ঝাড়ু গুণগত মানের। বছরখানেক ধরে শীত মৌসুমে ইউরোপ, আমেরিকা, লন্ডন, দুবাই, কাতার থেকে লোকজন এখানে এসে পাইকারি দরে ঝাড়ু কিনে নিয়ে যায়। এগুলো সেসব দেশের সুপারশপ, দোকান ও মার্কেটে বিক্রি করা হয়ে থাকে। শীত মৌসুমে আমাদের বেচাকেনা ভালো জমে। এ সময় দেশ–বিদেশ থেকে পাইকারেরা এসে ঝাড়ু কিনে নিয়ে যান। গত বছর সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকার লন্ডনপ্রবাসী আলী হোসেন ৩০ হাজার ফুলের ঝাড়ু কিনে নিয়ে যান।’

সম্প্রতি ঝাড়ুপল্লিতে গাজীপুরের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান নামের সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। দুবাইয়ে ওই প্রবাসীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘দুই বছর আগে এখান থেকে ২০ হাজার ঝাড়ু কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে দেশে ফিরেছি। আবার কেরানীগঞ্জে ঝাড়ু কিনতে এলাম। কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখেছি, এবার ঝাড়ুর দাম বেশি মনে হচ্ছে। ভাবছি এ বছর ১০ থেকে ১৫ হাজার ঝাড়ু কিনে নিয়ে যাব।’

ঝাড়ুর কারখানা ও দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ঝাড়ুশ্রমিকেরা ফুলের ঝাড়ু বানালে প্রতিটিতে পাঁচ টাকা এবং শলার ঝাড়ুর বানালে তিন টাকা করে পান। আল আমিন ঝাড়ু স্টোরের কর্মচারী জোছনা বেগম বলেন, তিনি প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টি ঝাড়ু বানাতে পারেন। তাতে যে টাকা পান, তা দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ শাখার সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, শুরুর দিকে আগানগর কেচি শাহ ডক এলাকায় ঝাড়ুর কিছু দোকান ছিল। এখন দোকানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, ঝাড়ুপল্লির বানানো ঝাড়ু রপ্তানিও হচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।