‘৭২ বছরের জীবনে ৬০ বছর ধরে একই কাজ করছি’

ব্যস্ত রাস্তার পাশে সাইকেল সারছেন মো. আমজাদ আলীছবি: প্রথম আলো

রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটছে। সেই ব্যস্ত রাস্তার পাশে একটি সাইকেল সারছেন একজন। ৭২ বছরের জীবনের ৬০ বছরই তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। নাম মো. আমজাদ আলী। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার শ্যামপুরের নগরপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

সম্প্রতি কথা হয় আমজাদ আলীর সঙ্গে। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের বিনোদপুর এলাকার রাস্তার ড্রেনের ওপর তাঁর দোকান। পেছনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর। সেই প্রাচীরে তাঁর নাম ও ফোন নম্বর চক দিয়ে লেখা আছে। ফোন নম্বরের ডিজিট মুছেও গেছে কয়েকটি। দোকান বলতে দুই পাশে দুটি টিনের ফালা দিয়ে কোনোরকমে আটকে রাখা জায়গা আর কী! ওপরে ত্রিপল দেওয়া। ভেতরে পুরোনো পার্স আর সারানোর সরঞ্জামের বাক্স। তিনি সাইকেল সারতে সারতেই কথা বলছিলেন।

আমজাদ আলীরা সাত ভাই ও এক বোন। ভিটেমাটি ছাড়া তেমন জায়গাজমি ছিল না। সংসারের প্রয়োজনে আমজাদকে ৮-১০ বছর বয়সেই কাজে লেগে যেতে হয়।

সাইকেল, ভ্যান, রিকশা সারানোর কাজ শেখা শুরু করেন তিনি। বললেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেই সাইকেল, ভ্যান, রিকশা সারানোর দোকান দেন। প্রথমে বাড়ির পাশে কাটাখালীর দেওয়ানপাড়া এলাকায় দোকান শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সেখানে দোকান চালিয়েছেন। এরপর রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ হওয়ায় তাঁর দোকান ভাঙা পড়ে। এর পর থেকে তিনি বিনোদপুর বাজারে রাস্তার পাশে দোকান শুরু করেন।

আমজাদ আলীর পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে এক মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। আমজাদ আলী বলেন, বছরের পর বছর এই কাজ করেই সংসার চালিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করেছেন। এই পেশা তাঁর জন্য লক্ষ্মী। আয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। ভাগ্য ভালো হলে ৫০০ টাকা আসে। একবার ৫০০ টাকা ভাঙলে আর ফেরানো যায় না। এই কাজের দিন ভালো যাচ্ছে না। এখন সবাই মোটরসাইকেল কিনে চালাচ্ছেন। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাইকেল চালাতেন। এখন শিক্ষার্থীরা চালায় মোটরসাইকেল আর শিক্ষকেরা বড় গাড়ি। তাঁর বয়স হয়েছে। লোকে এখন তরুণ মেকানিকদের কাছে যান।

আমজাদ আলী কাজ শিখেছিলেন জেবার আলী নামের একজনের কাছে। তাঁর কাছেও কাজ শিখেছেন চার-পাঁচজন। তিনি বলেন, ‘শিষ্যরা আমার চেয়ে ভালো কাজ পারে। এটা আমার ভালো লাগে। তাঁরা ভালো করছেন। আমি যেমন জেবার আলীর নাম মনে রেখেছি। তাঁরাও আমার নাম মনে রাখবেন।’

আমজাদ আলী যে জায়গায় বর্তমানে দোকান চালাচ্ছেন, সেই রাস্তা চার লেন করার কাজ চলছে। বর্তমানে দোকান চালাচ্ছেন ফুটপাতের ওপর। মাস গেলে এই জায়গার জন্য তাঁকে দিতে হয় ৬০০ করে টাকা। বলেন, ‘৭২ বছরের জীবনে ৬০ বছর ধরে একই কাজ করছি। এই জীবন তবু চলে যাচ্ছে। যদি জায়গাটা হারাতে হয়, তবে অন্য জায়গায় গিয়ে দোকান দেব। আর যদি তার আগেই শরীর পড়ে যায়, তবে এখানেই শেষ আমার।’