হবিগঞ্জে সভাপতির কথায় চলে আওয়ামী লীগ

আবু জাহির যে নির্দেশনা দেন, বাকিরা তা-ই পালন করেন। ফলে প্রবীণ ও পরীক্ষিত নেতারা আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন।

এক দশক ধরে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবু জাহির। তাঁর কথাই দলের শেষ কথা, তাঁর নির্দেশনাতেই চলে সব।

ফলে জেলার পুরোনো ও ত্যাগী নেতাদের বেশির ভাগই এখন নিষ্ক্রিয়। বিভিন্ন কমিটিতেও প্রবীণ নেতাদের জায়গায় স্থান পেয়েছেন সংসদ সদস্যের পছন্দের ব্যক্তিরা। নতুন-পুরোনো এ দ্বন্দ্বের ফলে উপজেলা কমিটিতে সমস্যা বাড়ছে।

অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে জেলা বিএনপির বিরোধ এতটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে যে দুটি পক্ষ পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছে। কার্যালয়ও আলাদা। কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের করা মামলায় গ্রেপ্তার-আতঙ্ক তো আছেই। দ্বন্দ্ব ও মামলার কশাঘাতে বিপর্যস্ত দলের নেতা-কর্মীরা।

আবু জাহিরের কথায় চলে সব

হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অধীন ৯টি উপজেলা ও ৬টি পৌরসভা কমিটি রয়েছে। নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও মাধবপুর উপজেলার কমিটি গঠিত হয়নি। বাকি ছয়টি উপজেলার কমিটি হলেও দ্বন্দ্ব রয়েছে।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের আটজন নেতা বলেন, আগামী নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে জেলা কমিটির সঙ্গে উপজেলা কমিটির সমন্বয় কম। কারণ, গণতান্ত্রিকভাবে কমিটিগুলো গঠন করা হয়নি। আবু জাহিরের পছন্দমতো গঠন করা হয়েছে।

দলের নেতা-কর্মীরা বলেন, ২০১৩ সাল থেকে লাখাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাহফুজুল আলম। ২০১৮ সালে তাঁকে বাদ দিয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুশফিউল আলমকে সভাপতি করে নতুন কমিটি ঘোষণা করে জেলা কমিটি। কমিটিতে রাখা হয়নি মাহফুজুলকে।

মাহফুজুল আলম বলেন, জেলা সভাপতি আবু জাহির যাঁকে পছন্দ করেন, তাঁকে কমিটিতে রাখেন। যাঁকে অপছন্দ করেন, তাঁকে নর্দমায় ফেলে দেন। তাঁর মতের বিরুদ্ধে এ জেলায় কেউ কথা বলতে পারেন না। তাঁর ইচ্ছায় চলে এ দলের রাজনীতি।

নেতা-কর্মীরা বলেন, কমিটি নিয়ে ক্ষোভ থাকায় নেতা-কর্মীরা অনেক সময় প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আবু জাহির। তাঁর সামনেই উপজেলার সভাপতি আকবর হোসেনের বক্তব্য নিয়ে কটূক্তি ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। পরে তা থামাতে হয় জেলা সভাপতিকেই।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিক হুসেন চৌধুরী বলেন, জেলা–উপজেলা কমিটিতে অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা–কর্মীকে রাখা হয়নি। যে কারণে দলে এ নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ আছে।

আবু জাহির বলেন, ‘আমাদের দল বড়। অনেককেই কমিটিতে রাখার সুযোগ হয় না। যাঁরা বঞ্চিত হন, তাঁরাই সমালোচনা করেন। বুঝতে হবে, যাঁরা সমালোচক তাঁরা কারা?’ তিনি আরও বলেন, অসন্তোষের বিষয়টি ঠিক নয়। কারণ, এখন পর্যন্ত যে ছয়টি উপজেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে হয়েছে। তাঁর একক সিদ্ধান্তে দল চলে—এটাও ঠিক নয়।

একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী

হবিগঞ্জ-৩ (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আবু জাহির এবারও মনোনয়ন চাইছেন। তিনি ছাড়াও দলীয় ফরম নিয়েছেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবুল হাসেম মোল্লা।

হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ এবারও নির্বাচন করতে চান। এ আসনে আরও মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর চৌধুরী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিক হুসেন চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নাজরা চৌধুরী, সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। আলমগীর চৌধুরী বলেন, সংসদ সদস্য স্থানীয় রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। যে কারণে তিনি এবার মনোনয়ন চাইবেন।

হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ খান। তিনি এবারও মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ময়েজ উদ্দিন, বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. আমির হোসেন, আজমিরীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মর্তুজা হাসান, বানিয়াচং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী প্রমুখ মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

ময়েজ উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব পছন্দ করেন। এ হিসেবে তিনি আশাবাদী, দল তাঁকেই এবার মনোনয়ন দেবে।

হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনের সংসদ সদস্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি টানা দুবারের সংসদ সদস্য। তিনি ছাড়াও এ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন জাকির হোসেন চৌধুরী অসীম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাকির হোসেন চৌধুরী, চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর হোসেন, যুবলীগের সাবেক নেতা আইনজীবী সায়েদুল হক।

আকবর হোসেন বলেন, মন্ত্রীকে এলাকার মানুষ সব সময় কাছে পান না। তাই দলের লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবার তিনি দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন।

কোন্দলে বিভক্ত জেলা বিএনপি

জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলেন, ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল আবুল হাসিমকে আহ্বায়ক করে বিএনপির ৪৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া ছয়টি উপজেলায় কাউন্সিলরদের ভোটে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সদর, নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় এখনো কমিটি হয়নি। ছয়টি পৌরসভার মধ্যে দুটিতে কমিটি নেই।

তবে দল এখন দুটি পক্ষে বিভক্ত। একটি পক্ষে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জি কে গউছ। আরেক পক্ষে আছেন যুগ্ম আহ্বায়ক আহমুদুর রহমান ও ইসমাইল তরফদার। পাশাপাশি অপর যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হকও এ দুই পক্ষের বাইরে গিয়ে আলাদা করে নানা কর্মসূচি পালন করেন।

নেতা-কর্মীরা বলেন, জি কে গউছ এখন জেলা বিএনপির সবচেয়ে বড় নেতা। এ ছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বও তাঁর হাতেই। তাঁর এ একক নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি নন ইসমাইল তরফদার ও আহমুদুর রহমান। তাঁরা জেলা বিএনপির শায়েস্তানগর কার্যালয়ে আসেন না। তাঁরা শহরের সিনেমা হল এলাকায় আলাদা কার্যালয়ে বসেন।

আহমুদুর রহমান বলেন, ‘দলীয় শৃঙ্খলার অভাবের কারণে আমরা শায়েস্তানগর কার্যালয়ে যাই না। আমরা মনে করি, সিনেমা হল এলাকায় শান্তিপূর্ণ বা স্বাচ্ছন্দ্যভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করা যায়। দলের অধিকাংশ নেতা–কর্মী এখানেই আসেন। হবিগঞ্জ বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী।’

জি কে গউছসহ ১৪ নেতা-কর্মী বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আছেন। গউছের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘হবিগঞ্জে বিএনপির জনপ্রিয়, ত্যাগী ও পরীক্ষিত রাজপথের নেতা-কর্মীরা জি কে গউছের সঙ্গেই আছেন। আমরা আলাদা কর্মসূচি করি না। সবাইকে নিয়েই দলীয় কর্মসূচি পালন করি। আমরা মনে করছি, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি সঠিক পথেই চলছে।’

মামলায় বিপর্যস্ত নেতা-কর্মী

কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ছেন নেতা-কর্মীরা। মামলার সংখ্যাও কম নয়। দলীয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৫৯টি মামলা আছে জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি প্রায় এক হাজার।

জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, তাঁর নিজের নামেই ২৫টির বেশি মামলা আছে। অনেকের নামেই ২৫ থেকে ৪০টি পর্যন্ত মামলা আছে। সব মিলিয়ে কম করে হলেও চার থেকে পাঁচ হাজার নেতা-কর্মী মামলার আসামি। নেতা-কর্মীদের কোনো না কোনো মামলার হাজিরা থাকায় প্রতিদিন এক বেলা তাঁদের আদালতেই কাটছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর একটা প্রভাব থাকে। মামলা ও পুলিশের হয়রানি সত্ত্বেও হবিগঞ্জ বিএনপি এখনো অনেক শক্তিশালী বলে মন্তব্য করেন তিনি।