একসময়ের জনাকীর্ণ বাজারটি এখন শ্রীহীন

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভা নদীর পাড়ে শতবর্ষী ‘বাগিচাবাজার’ছবি: আনিস মাহমুদ

লোভা নদীর পাড়েই ‘বাগিচাবাজার’। শত বছর আগে হাতে বাওয়া নৌকায় পাল উড়িয়ে নানা জায়গা থেকে এখানে বণিকেরা আসতেন। তাঁদের কাছে থাকত হরেক মালামাল। আশপাশের গ্রাম-জনপদ থেকে সেসব কিনতে আসতেন শত শত মানুষ। তবে ব্রিটিশ আমলের ডাকসাইটে জনাকীর্ণ এ বাজার এখন শ্রীহীন। বিপুল ঐতিহ্যের স্মৃতি নিয়ে তিনটি মাত্র স্থায়ী দোকানের এ বাজার এখন টিকে থাকার যুদ্ধে কোনোরকমে লড়াই করছে।

শতবর্ষী বাগিচাবাজারের অবস্থান সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। এখানে তিনটি স্থায়ী দোকান আছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাজার চালু থাকে। তিন দোকানের দুটিতে চা, পান, শিঙাড়া, নিমকি, গজা, ছোলা, চিপস, চানাচুরসহ নানান খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হয়। অন্যটিতে এসব পণ্যের পাশাপাশি কিছু ভুসিমালও বিক্রি করা হয়। এর বাইরে ওই বাজারের এক বাসিন্দা তাঁর ঘরে ছোট পরিসরে জ্বালানি তেল বিক্রির পাশাপাশি দরজির কাজ করেন।

স্থানীয় লোকজন বলেন, লোভাছড়া চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্যই মূলত হাটটি প্রতিষ্ঠিত হয়। চা-শ্রমিকদের পাশাপাশি নিহালপুর, আসামপাড়া, নোয়াখান, লালমাটি গ্রামের বাসিন্দারাও বাজার-সওদা করতে আসেন। সপ্তাহে প্রতি রোববার এখানে ঘটা করে হাট বসে, ওই দিনকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘হাটবার’। সেদিন কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে কিছু ব্যবসায়ী চাল, ডাল, লবণ, তেল, মরিচ, মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে আসেন। একসময় মানুষে গিজগিজ করতে থাকা এ বাজারে এখন প্রতি হাটবারে ২০০ থেকে ২৫০ জন আসেন। তবে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় হাটটি থাকে প্রায় জনশূন্য।

বাগিচাবাজারের স্থায়ী তিনটি দোকানের মধ্যে একটির স্বত্বাধিকারী দীপক চন্দ্র দাস (৪৭)। তাঁর আদি বাড়ি হবিগঞ্জ। ৩০ বছর আগে বিয়ে করে এখানকার বাসিন্দা হয়ে দোকানটি চালু করেন। দীপক বলেন, একটা সময়ে তাঁর দোকানে প্রচুর বেচাকেনা হতো। গত ছয় থেকে সাত বছর আগে বাগিচাবাজারের কিছুটা উজানে চিন্তারবাজার নামে একটি হাট চালু হয়। তুলনামূলকভাবে যাতায়াতের সুবিধা বেশি থাকায় বাজারটি জমজমাট হতে থাকে। ধীরে ধীরে এখানকার ব্যবসায়ীরাও স্থানান্তরিত হয়ে চিন্তারবাজারে চলে যান।

তিনটি মাত্র স্থায়ী দোকান আছে এই বাজারে। সেখানে জড়ো হয়ে আড্ডা দেন আশপাশের মানুষজন
ছবি: আনিস মাহমুদ

দীপক বলেন, বাগিচাবাজারের পাশেই ছিল একটি পাথরকোয়ারি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ছয় বছর ধরে ওই কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ। তাই এ বাজারের ক্রেতা হিসেবে থাকা কোয়ারির ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকেরাও নিজেদের এলাকায় চলে যাওয়ায় ক্রেতা হারিয়েছে বাগিচাবাজার। এর মধ্যে চিন্তারবাজার চালু হওয়ায় আশপাশের অনেকেই সেখানকার স্থায়ী ক্রেতা হয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে ক্রেতা হারিয়ে বাগিচাবাজার এখন টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। অথচ একটা সময়ে বাগিচাবাজারে স্থায়ী দোকানই ছিল ৩০ থেকে ৪০টি।

গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, বাজারজুড়ে সারি সারি সবুজ গাছ। থিকথিকে কাদা জমে আছে। বাজারের ভেতরে স্থানে স্থানে বাঁশ-টিনের বেড়াহীন সাতটি দোকান আছে। এসব দোকানে হাটবারে কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে আসা ব্যবসায়ীরা নিজেদের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করেন বলে স্থানীয় লোকজন জানালেন।

বাজার ঘুরে দেখার সময় বৃষ্টি মাথায় করে অর্ধবয়স্ক এক ব্যক্তিকে কাকভেজা হয়ে দীপক দাসের চায়ের দোকানে ঢুকতে দেখা গেল। এর বাইরে তিন যুবকের একজনকে মাথায় পলিথিন বেঁধে ও দুজনকে ছাতা হাতে একই দোকানে ঢুকতে দেখা যায়। তাঁরা ওই দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একসময় গল্প-আড্ডায় মশগুল হন। পাশের আরেকটি দোকানে বসে কয়েকজন ব্যক্তিকে চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খেতে দেখা গেল। কেউ কেউ কাঁচা মরিচ দিয়ে আয়েশ করে শিঙাড়াও খাচ্ছিলেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, বাজারের দোকানগুলোয় বিদ্যুৎ নেই। সৌরবিদ্যুতে তাঁরা চলেন। এ কারণে রাত ৮টার মধ্যেই দোকানিরা তাঁদের দোকান বন্ধ করে দেন। দিনেই যেখানে বাজারটি প্রায় নীরব থাকে, সেখানে সন্ধ্যার পর ক্রেতার অভাবে বাজারটি ভুতুড়ে হয়ে পড়ে। এরপরও সন্ধ্যার পর কিছু ব্যক্তি দল বেঁধে বাজারে এসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাময়িক আড্ডা জমান।

বাগিচাবাজারে দুই বন্ধুর সঙ্গে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডারত নোয়াখান কালিজুড়ি গ্রামের বাসিন্দা কাওসার আহমদ (২৬) বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই এ বাজারে আসি। গল্পগুজব করি। হাটবার ছাড়া প্রতিদিন গড়ে হয়তো এক শ মানুষ আসেন।’