চট্টগ্রামে সিডিএর জলাবদ্ধতার প্রকল্পে ব্যয় বাড়ছে তিন হাজার কোটি টাকা

ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা। ছবিটি রহমতগঞ্জ এলাকার
ছবি: ফাইল ছবি

সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ঠিকভাবে না করেই নেওয়া হয়েছিল প্রকল্প। কোন খাতে কত ব্যয় হবে, তারও সঠিক পরিকল্পনা ছিল না। নকশায় ছিল নানা ত্রুটিবিচ্যুতি। কাজ শুরুর পর ধরা পড়তে শুরু করে এসব। তাই সংশোধন করতে হয় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। আর সংশোধনেই ব্যয় বেড়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এখন খরচ হবে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের আগে একনেকের সভা হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ সভায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসনের সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদিত হতে পারে।

সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট। ওই সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনেই কাজ শেষ করার কথা ছিল।

কিন্তু প্রথম বছরে মূল কাজই শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। বর্তমান মেয়াদ হচ্ছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু এ সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবে না সিডিএ। সংশোধিত প্রকল্পে বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরেছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।

প্রকল্পটির বিপুল ব্যয় বৃদ্ধির জন্য অনুমানভিত্তিক ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প নেওয়া ও সিডিএর পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রকল্পে ত্রুটি থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিডিএর চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি বলেন, আসলে প্রকল্পটিতে আগে ভুল ছিল। ভালোমতো স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) করে নেওয়া হয়নি। স্টাডি করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তবে ব্যয় বৃদ্ধির কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যেমন জমি অধিগ্রহণ ব্যয় দেড়গুণের পরিবর্তে তিন গুণ হয়েছে। কাজের পরিমাণও বেড়েছে।

২০২১ সালের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প তদারককারী প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিডিএর প্রকল্পটি নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এত বড় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনটিও সঠিকভাবে করা হয়নি। যেটি করা হয়েছে, সেটিও অনেক ত্রুটিপূর্ণ। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে অর্থবছরভিত্তিক আর্থিক ও বাস্তব কর্মপরিকল্পনাও ছিল না সিডিএর। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হয়েছে। এখন ব্যয় ও সময় দুটি বাড়ছে।

বৃষ্টির পর পানি উঠেছে চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের চেয়ারম্যানঘাটা এলাকায়
ফাইল ছবি

২০২১ সালে তৈরি করা প্রতিবেদনেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, প্রকল্পের কাজের যে গতি, তাতে বাকি কাজ শেষ করতে আরও পাঁচ বছর সময় লাগবে। এখন সে শঙ্কা বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। সিডিএ নিজেই ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে চেয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে সিডিএর দুটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি করে দুটি। এই চার প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। গত ছয় বছরে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এই বিপুল টাকা খরচের পরও চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতার কোনো উন্নতি হয়নি। শুধু এ বছরেই এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ বার জলাবদ্ধতা হয়েছিল বন্দরনগর।

এই চার প্রকল্পের একটিও ঠিক সময়ে শেষ হয়নি। সব কটিতেই ছিল নানা ধরনের ত্রুটি। সিডিএর বড় প্রকল্পটি ছাড়া অন্য তিনটি প্রকল্প আগে সংশোধন করা হয়েছে। এখন সিডিএর বড় প্রকল্পটি সংশোধিত হওয়ার পর অনুমোদন পেতে যাচ্ছে।

যে কারণে বাড়তি ব্যয়

প্রকল্পের ব্যয় কী কী কারণে বাড়ছে, তা নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। সিডিএর তথ্যানুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়া, জোয়ার প্রতিরোধক ফটকের (টাইডাল রেগুলেটর) নকশা পরিবর্তন, নতুন কাজ যুক্ত হওয়ার কারণে ব্যয় বেড়েছে।

প্রকল্প নেওয়ার সময় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ ছিল দেড়গুণ। কিন্তু কাজ শুরুর পর তা হয়ে যায় তিন গুণ। প্রথম দফায় ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। জমির পরিমাণ কমিয়েও ব্যয় কমানো যায়নি। ২ হাজার ২৮০ কাঠা জমিতে খরচ পড়ছে ১ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এ খাতে বেড়েছে ১৬৩ কোটি টাকা। স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ছিল ১৭ কোটি টাকা। এখন লাগবে ২০৭ কোটি টাকা।

১৫ কিলোমিটার বিটুমিনাস রাস্তা নির্মাণে খরচ হবে ৪৫ কোটি টাকা। শুরুতে এ খাতে কোনো ব্যয় ছিল না।

এদিকে প্রকল্পের আওতায় থাকা ৩৬টি খাল থেকে কাদা অপসারণ ও মাটি খননে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৫৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এখন সংশোধিত প্রকল্পে খালের মাটি খনন ও গভীরতা বৃদ্ধির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৪ কোটি টাকা। একলাফে ব্যয় বেড়েছে ২৬৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

এদিকে বড় অঙ্কের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে খালের পাশে আরসিসি প্রতিরোধদেয়াল নির্মাণে ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা, আরসিসি কালভার্ট স্থাপনে ৫৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া মহেশ খালসহ পাঁচটি খালের মুখে জোয়ার প্রতিরোধক ফটক (টাইডাল রেগুলেটর) নির্মাণে যেখানে ৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এখন খরচ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।

খালের ভেতরে ৪২টি বালুর ফাঁদ বা সিল্টট্র্যাপ নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৯ কোটি টাকা। কিন্তু এখন ২৭টি করতেই ব্যয় হচ্ছে ১১৯ কোটি টাকা। নতুন নালা নির্মাণ ও পুরোনো নালা সম্প্রসারণে ব্যয় বেড়েছে ১৩১ কোটি টাকা।

প্রকল্প ব্যয় যাতে দ্বিগুণের বেশি না হয়, সে জন্য কিছু খাতে খরচ কমানো হয়েছে। আবার কিছু কাজও বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন আগে যেখানে ৮৫ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা করার কথা, এখন সেখানে করা হচ্ছে ২১ কিলোমিটার। ব্যয় কমেছে ২০৪ কোটি টাকা। তিনটি জলাধার বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে ৪৩ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে।

অনুমানভিত্তিক ও ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প নেওয়ার কারণেই এভাবে ব্যয় বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

তাই প্রকল্পের দায়িত্ব সিডিএকে দেওয়াটাই ছিল সরকারের ভুল। অনুমোদনের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছে সংস্থাটি। ঠিকভাবে ডিপিপি না করার ফলে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে নানা সংকটে পড়তে হয়েছে, যা সংশোধন করতে হচ্ছে। এসব কাজ করতে বাড়তি সময় লাগছে। আর এতে নগরবাসীর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।