বেশি দামের আশায় অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলছেন কৃষক, ফলন কমার শঙ্কা
পেঁয়াজের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত পাবনার সাঁথিয়া। উপজেলার বায়া গ্রামের ফসলের মাঠে আজ সোমবার সকালে খুশিমনে জমি থেকে আগাম বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলছিলেন কৃষক মনসুর আলী। যদিও তাঁর এই পেঁয়াজ পুরোপুরি পরিপক্ব হতে এখনো অন্তত দুই সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। বর্তমান বাজারে ভালো দাম পাওয়ার আশায় তিনি আর অপেক্ষা করছেন না। গত বছর একই জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করে উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। এবার তাই ঝুঁকি নিতে চান না।
মনসুর আলী বলেন, ‘গত বছর ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বেচছিল্যাম। ম্যালা লস হইছিল। তবে এবার শুরুতে দাম ভালোই যাতেছে। আইজও বাজারে মুড়িকাটা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে বেচাকেনা হইছে। তাই আর ঝুঁকি নিব্যার চাই না। তবে পেঁয়াজ এখনো পুরোপুরি পুষ্ট হয় নাই।’
মনসুর আলীর মতো সাঁথিয়ার অনেক কৃষকই এবার বেশি দামের আশায় অপরিপক্ব মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলে বাজারে আনছেন। কারণ, এ বছর মৌসুমের শুরুতেই পেঁয়াজের দামে গত বছরের তুলনায় উল্টো চিত্র দেখাচ্ছে। আজ সাঁথিয়ার পাইকারি বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ প্রতি মণ ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। পুরোনো হালি পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে।
কৃষক ও উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মতো এবারো প্রতি মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। তাই এখন বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকেরা।
কৃষকদের ভাষ্য, গত বছর মৌসুমের শুরুর কয়েক দিন মুড়িকাটা পেঁয়াজ দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি মণ দরে বিক্রি হলেও মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে ব্যাপক দরপতন। একপর্যায়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন তাঁরা। সেই ক্ষতির অভিজ্ঞতা থেকেই এবার দাম ভালো থাকতেই পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন অনেক কৃষক। তবে অপরিপক্ব অবস্থায় পেঁয়াজ তোলায় স্বাভাবিকের তুলনায় ফলন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি এই পেঁয়াজ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না, দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, পুরোপুরি পরিপক্ব হলে প্রতি বিঘায় ৬০ মণের ওপরে ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু আগেভাগে তুলে ফেললে তা কয়েক মণ পর্যন্ত কমে যায়। এতে সাময়িকভাবে দাম ভালো পেলেও শেষ পর্যন্ত মোট উৎপাদন কমে যায়, তা ছাড়া একসঙ্গে বেশি পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করলে দাম আবার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাঁথিয়ায় এবার ১৬ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। পাবনায় মুড়িকাটা ও হালি—এই দুই পদ্ধতিতেই পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে। মুড়িকাটা পদ্ধতিতে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আবাদ করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। অন্যদিকে হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজের আবাদ করে মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। সেই হিসেবে এখন মুড়িকাটা পেঁয়াজ সবেমাত্র কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের হিসেবে আজ পর্যন্ত মোট ফলনের মাত্র শতকরা তিন ভাগ মুড়িকাটা পেঁয়াজ উত্তোলন হয়েছে।
আজ সাঁথিয়ার বিভিন্ন পাইকারি পেঁয়াজের হাট ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো হালি পেঁয়াজের সঙ্গে নতুন বা মুড়িকাটা পেঁয়াজও হাটে উঠেছে। তবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ প্রতি মণ ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে ও পুরোনো হালি পেঁয়াজ সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
উপজেলার করমজা চতুরহাটের পেঁয়াজের ব্যবসায়ী (পাইকারি) নাজিম উদ্দিন ও জহুরুল ইসলাম জানান, কয়েক দিন হলো হাটে মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। তবে হাটে ওঠা এই পেঁয়াজের বেশির ভাগ অংশই আরও কয়েক দিন জমিতে থাকলে ভালো হতো। অনেক পেঁয়াজই পুরোপুরি বড় হতে পারেনি। কৃষকেরা ভালো দাম দেখে বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ নিয়ে আসছেন।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, অক্টোবরের শুরুর দিকে খুব অল্প জমিতে যতটুকু মুড়িকাটা আবাদ করা হয়েছিল সেগুলোই কেবল এখন পরিপক্ব হয়েছে। কিন্তু বাজারে ভালো দাম দেখে সেই পেঁয়াজের পাশাপাশি কিছুটা অপরিপক্ব পেঁয়াজও কৃষকেরা বাজারে তুলে আনছেন। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা চলছে।