রাতভর উত্তেজনার পর ক্যাম্পাস শান্ত, কর্মরিবতির মধ্যে সিন্ডিকেট সভা আজ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের পশ্চিম পাশে বসে আছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আজ রোববার সকাল সাড়ে নয়টার দিকেছবি : শফিকুল ইসলাম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা নিয়ে গতকাল শনিবার বিকেল থেকে উত্তেজনা শুরু হয়, চলে গভীর রাত পর্যন্ত।। তবে আজ রোববার সকালে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের কাউকে দেখ যায়নি।

এদিকে আজ দিনভর পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তবে সকালে ক্যাম্পাসে সব একাডেমিক ভবনের ফটকের তালা খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ভবনও খুলেছে। শিক্ষার্থীদেরও বাসে করে ক্যাম্পাসে আসতে দেখা গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পৌনে নয়টার দিকে ক্যাম্পাসে আসা শুরু করেছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে, কেউ নিজস্ব বাহনে করে ক্যাম্পাসে আসছেন। তবে তাঁরা জানেন না আজ কীভাবে কর্মবিরতি পালন করা হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির সভাপতি মুক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই আজ কাজ থেকে বিরতি থাকবেন। কোনো ধরনের কাজে তাঁরা যুক্ত হবেন না। আর ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ থাকবে। তবে ক্যাম্পাসে তাঁরা দৃশ্যমান (জমায়েত) কোনো কর্মসূচি পালন করবেন না। সিন্ডিকেট সভার দিকে তাঁদেরও নজর থাকবে। কখন সিন্ডিকেট সভা হবে জানেন না তাঁরা। তবে এই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে কী ফল আসে তার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

আজ সকালে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাস ভবনের সামনেও কেউ নেই। সেখানে গতকাল রাতে পড়ে থাকা আবর্জনা ঝাড়ু দেওয়া হয়েছে। সেখানকার একজন নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, শনিবার রাত সাড়ে তিনটা থেকে আজ ভোর চারটার মধ্যে শিক্ষার্থীরা চলে যান। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন বলে তিনি জানান। গেটের তালা দেখিয়ে বলেন, এই তালা ইট দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। উপাচার্য রাতভর জেগে ছিলেন। এখন তিনি ঘুমাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

এর আগে গতকাল বেলা তিনটার দিকে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হলে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তাঁর গাড়ি আটকে দেন। পরে তিনি হেঁটে তাঁর বাসভবনের দিকে যেতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর বাসভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দিলে তিনি জুবেরী ভবনের দিকে যান। তাঁর সঙ্গে প্রক্টর মাহবুবর রহমানও ছিলেন। বিকেল সোয়া চারটার দিকে জুবেরী ভবনে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাত্রদের হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে চারটার দিক থেকে জুবেরী ভবনে সহ-উপাচার্যসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা।

এমন পরিস্থিতিতে রাত পৌনে ১০টার দিকে সহ-উপাচার্যসহ অন্য শিক্ষকদের ‘লাঞ্ছিত’ করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আজ কর্মবিরতির ডাক দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি আবদুল আলিম। সিনেট ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীও কর্মবিরতিতে থাকবেন বলে উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের ফটক তালাবদ্ধ। আজ রোববার সকালে
ছবি : শহীদুল ইসলাম

রাত সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জুবেরী ভবন ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডসংলগ্ন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে স্লোগান দেন। এতে সহ-উপাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষক প্রায় সাত ঘণ্টা পর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পান। এ সময় বিভিন্ন হল থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এসে জড়ো হন প্যারিস রোডসংলগ্ন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে। তাঁদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীরাও ছিলেন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, রোববার (আজ) এ নিয়ে জরুরি সিন্ডিকেট সভার আহ্বান করা হয়েছে।

তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেননি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাঁরা উপাচার্যের নির্বাহী ক্ষমতাবলে এ সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরে রাত গভীর হওয়ায় ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে চলে যেতে শুরু করেন।

এর আগে রাত দেড়টার দিকে নিজ বাসভবনের ফটকের কাছে আসেন উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব। মাইকে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রোববার জরুরি সিন্ডিকেট সভার আহ্বান করা হয়েছে। আশা করছি, প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।’

উপাচার্যের এমন বক্তব্য শুনে ফটকের বাইরে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। তখন উপাচার্য বাসভবনের ভেতরে চলে যান।

গত বৃহস্পতিবার ভর্তি উপকমিটির সভায় ১০ শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনা হয়। ওই দিন রাতে এটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন।

শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কম, ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ

শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্ণদিবস কর্মবিরতির কারণে আজ বেশির ভাগ বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। পাশাপাশি বিভিন্ন অফিস ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজও বন্ধ আছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনাও অনেক কম। দোকান-রেস্তোরাঁ বসেছে হাতে গোনা। অধিকাংশ বিভাগের ক্লাসরুম ও অফিসকক্ষ বন্ধ আছে।

সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। অন্তত ১৫টি বিভাগের ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের কারও আজ ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি।

সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের পশ্চিম পাশের ফটকে কথা হয় শাফিন কবিরের সঙ্গে। শাফিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেলা ১১টায় একটি কোর্সের ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভাগে এসে দেখি সব তালাবদ্ধ। এখন ফিরে যাচ্ছি।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের সামনের দোকানি সুরুজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কম। ক্লাস না হওয়ায় সকাল থেকে ৫০০ টাকাও ব্যবসা হয়নি। এতক্ষণে অন্যান্য দিন তিন থেকে চার হাজার টাকা বিক্রি হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের আজ সকাল সাড়ে নয়টায় সেমিস্টার পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। তবে শিক্ষার্থীরা সকালে জানতে পারেন, আজ পরীক্ষা হবে না। এই বিভাগের শিক্ষার্থী কাওছার আহমেদ বলেন, ‘আজ আমাদের সেমিস্টার ফাইনালের ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। তবে সকালে আমরা বিভাগে এলে পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান জানান, আজ পরীক্ষা হবে না। কালও পরীক্ষা আছে। সেটি হবে কি না, তা সিন্ডিকেট সভার পর জানানো হবে।’

ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ রেস্তোঁরা বন্ধ আছে। আজ রোববার সকালে জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবনের পাশে
ছবি : প্রথম আলো

বেলা ১১টায় দেখা যায়, একদল শিক্ষার্থী পরিবহন মার্কেটে একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, আজ সকালে ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কর্মচারীরা জানান, চেয়ারম্যান স্যার নির্দেশ দিয়েছেন, আজ কোনো ক্লাস হবে না।

দোকান-রেস্তোরাঁ বসেছে কম, ক্লাস-অফিসকক্ষ খোলেনি

বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনের বেশির ভাগ বিভাগের ক্লাস-অফিসকক্ষ বন্ধ আছে। কিছু বিভাগের অফিসকক্ষ খোলা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখা যায়নি। বেলা ১১টা নাগাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের পূর্ব পাশের পকেট গেটও তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবনের পূর্ব পাশের দুটি রেস্তোরাঁও বন্ধ আছে।