গরমে বাক্স ছাড়ছে মৌমাছি আশানুরূপ মধু পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে একটি মৌবাক্স থেকে ৬–১০ কেজি মধু পাওয়া যায়। কিন্তু এবার বেশির ভাগ বাক্সে তিন থেকে ছয় কেজি মধু মিলছে।

বাড়িতে স্থাপন করা মৌবাক্স। প্রচণ্ড গরমের কারণে এসব বাক্সে মৌমাছি এখন খুব একটা আসে না। ফলে ভরা মৌসুমেও আশানুরূপ মধু পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মধ্যভাগেছবি: প্রথম আলো

প্রচণ্ড দাবদাহে টিকতে না পেরে দলে দলে মধু চাষে ব্যবহৃত মৌবাক্স (স্থানীয় ভাষায় কলোনি) ছাড়ছে মৌমাছিরা, শুকিয়ে যাচ্ছে মধুর চাক। এতে মৌমাছির স্বাভাবিক প্রজনন ও মধু উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, ইসলামপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামে এ রকম হাজারের মতো মৌবাক্স রয়েছে। মৌমাছির ওপর নির্ভর করে বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে এসব মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এবার গরমে ভরা মৌসুমেও (বৈশাখ মাস) মধুর উৎপাদন কমে গেছে।

মধুচাষি মঙ্গল মিয়ার বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কোনাগাঁওয়ে। প্রায় ১৩ বছর ধরে তিনি মধু চাষ করছেন। এ বছর তাঁর ৬০টি মৌবাক্স আছে। এর মধ্যে ১৩টি নিজের তত্ত্বাবধানে, বাকিগুলো বিভিন্নজনের কাছে বর্গা দিয়েছেন। বর্গাচাষিরা বাড়ির সুবিধাজনক স্থানে এসব মৌবাক্স স্থাপন করে নিয়মিত দেখাশোনা করেন। নিয়ম অনুযায়ী, উৎপাদিত মধুর তিন ভাগের এক ভাগ পেয়ে থাকেন বর্গাচাষি, দুই ভাগ পান মৌবাক্সের মালিক।

মঙ্গল মিয়া জানান, স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে প্রতিবার একটি মৌবাক্স থেকে ৬–১০ কেজি পর্যন্ত মধু পেয়ে থাকেন। এবার একটি বাক্সে সর্বোচ্চ সাড়ে আট কেজি পেয়েছেন। বেশির ভাগ বাক্সে তিন থেকে ছয় কেজি মধু মিলছে। বুনো ফুল কম থাকায় পাহাড়ি মধু প্রায় মিলছেই না। প্রাকৃতিক মৌচাকেও মধু নেই।

গত বৃহস্পতিবার মঙ্গল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গরমে মধু চাষে সমস্যা হচ্ছে। মৌমাছিরা বাসার মধ্যে থাকে না। বাক্সের বাইরে চলে আসে। এখন মধুর ভরা মৌসুম। বাক্সে মধু থাকলে এমনিতেই বাসা গরম থাকে। এই গরমের সময় আরও গরম পড়েছে। এতে মধুর উৎপাদন কমেছে।

কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষ উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদ, মধুচাষি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় ধরে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মধুর চাষ হচ্ছে। মধু চাষে একবারই বিনিয়োগ করতে হয়। রানি মৌমাছিসহ একটি মৌবাক্স স্থাপন করতে খরচ হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এরপর শুধু এই মৌবাক্সের পরিচর্যা করতে হয়। একটি মৌবাক্স বা কলোনি থেকে বছরে তিন থেকে চারবার মধু সংগ্রহ করা যায়। প্রতিবার ৬ থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যায়। এবার গরমের কারণে ভরা মৌসুমে প্রতিটি কলোনিতে অন্য বছরের তুলনায় তিন থেকে চার কেজি মধু কম মিলছে। প্রচণ্ড গরমে মৌবাক্সে মধুর চাক শুকিয়ে যাচ্ছে। মৌমাছি চলে গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অনেক সবজি আবাদে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব সবজি বা ফসলের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছিরা মারা পড়ছে। এতে শুধু মধুর উৎপাদনই কমে যায়নি, মৌমাছির প্রজননও ব্যাহত হচ্ছে। ফসলের পরাগায়নেও মৌমাছির ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ, জালালপুর, উত্তর ভাগ, নইনারপাড়, বনগাঁও, হেরেঙ্গা বাজার, কোনাগাঁও, কাঠালকান্দি, কানাইদেশি, নতুনবাজার, তৈলংবাড়ি, আধকানি, নওয়াগাঁও, পূর্ব জালালপুর, পশ্চিম জালালপুর, কেওয়ালি ঘাট, হকতিয়ারখলাসহ বিভিন্ন গ্রামে মধুর চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া কমলগঞ্জ সদরের শ্রীনাথপুর, আলেপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে বিচ্ছিন্নভাবে মধু চাষ করছেন অনেকে। বাড়ির মধ্যে, খেতের আলসহ সুবিধাজনক স্থানে কলোনি (মৌবাক্স) স্থাপনের মাধ্যমে এই মধু চাষ করা হচ্ছে। একেকজন চাষির দুই থেকে দুই শতাধিক কলোনি আছে। পুরো কমলগঞ্জ উপজেলায় চার শতাধিক মধুচাষি আছেন। প্রতি কেজি মধু ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মধুচাষের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, এখন চলছে মধু সংগ্রহের ভরা মৌসুম। এই সময় গ্রামে, পাহাড়ে বিভিন্ন জাতের ফলদ ও বুনো ফুল ফোটে। মৌমাছি স্বচ্ছন্দে মধু সংগ্রহ করে, তাই দ্রুতই কলোনি মধুতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। বৈশাখ মাসে একেকটি কলোনি থেকে দুবার মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসে একবার মধু সংগ্রহ করা হয়। প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে জ্যৈষ্ঠ মাসেও দুবার মধু সংগ্রহ করা যায়। এবার গরমের কারণে চাষিরা মধু কম পাচ্ছেন। ফুলের অবস্থা খারাপ। ফাল্গুন মাসে কিছু ফুল ছিল। বৃষ্টি না থাকায় ফুলে রস নেই।

কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষ উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘আমার প্রায় ২৫০টি কলোনি আছে। এর মধ্যে গরমে ৫০–৬০টি কলোনি থেকে মৌমাছি চলে গেছে। অন্য বছরে মৌমাছিরা যেত না। এই সময়ে কলোনিতেই থাকত। এখন (বৈশাখ মাস) মধু তোলার সময়। সর্বোচ্চ মধু এই সময়েই পাওয়া যায়। দুইবার মধু সংগ্রহ করা হয় বৈশাখ মাসে। যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে হয়তো জ্যৈষ্ঠ মাসে উৎপাদন কিছু বাড়তে পারে।’

কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষ উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের উপদেষ্টা, লেখক ও লোকগবেষক আহমদ সিরাজ গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরমে মৌমাছি বাক্স থেকে বাইরে এসে বসে থাকে। কোনো বাক্স থেকে চলে যায়। আমি এবার একটা বাক্স থেকে তিন কেজি মধু পেয়েছি, গতবার পাঁচ কেজি পেয়েছিলাম।’