ভবনের ছাদ থেকে ৫ ঘণ্টা গুলিবর্ষণ, একটি অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি
চারতলা ভবনের ছাদে ২০-২৫ জন ব্যক্তি। তাঁদের অনেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরা একজন কিছুক্ষণ পরপর বাঁশি বাজাচ্ছেন। সেই বাঁশি বেজে উঠতেই একসঙ্গে ভবনের নিচে জড়ো হওয়া মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে জিরিয়ে নিয়ে ছাদে থাকা একটি ড্রাম থেকে শরবতও পান করছিলেন সেই অস্ত্রধারীরা। এভাবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে গুলি ছোড়া হয় ভবনটির ছাদ থেকে।
গত বছরের ৪ আগস্ট এই দৃশ্য দেখা যায় লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলায়। ওই অস্ত্রধারীদের গুলিতে চারজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের একটিও উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিরা।
দিনের আলোতে গুলিবর্ষণের এ ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জানায়, ছাত্র-জনতার কর্মসূচিতে হামলার সময় পিস্তল, শটগান ও কাটাবন্দুক ব্যবহার করতে দেখা যায় অস্ত্রধারীদের। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে অধিকাংশ অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। অস্ত্রধারীদের প্রায় সবাই যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মী। এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলেও অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চার শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজের সাদ আল আফনান, দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজের সাব্বির হোসেন রাসেল, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের কাউছার হোসেন ও একই কলেজের ওসমান গণি।
যেভাবে ঘটনার শুরু
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা অবস্থান করেন ঝুমুর এলাকায়। সকাল ১০টার দিকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এ সময় শহরের উত্তর তেহমনী থেকে ঝুমুর পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী চলে এই সংঘর্ষ। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতারা পিছু হটেন। এর মধ্যে কিছু নেতা-কর্মী আশ্রয় নেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিনের বাসার সামনে।
দুপুর ১২টার দিকে শত শত আন্দোলনকারী এ কে এম সালাহ উদ্দিনের বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় সালাহ উদ্দিন ও তাঁর বাহিনীর লোকজন বাসার ছাদ থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। শতাধিক আন্দোলনকারীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চারজন শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজের সাদ আল আফনান, দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজের সাব্বির হোসেন রাসেল, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের কাউছার হোসেন ও একই কলেজের ওসমান গণি । ওই দিন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা একপর্যায়ে এ কে এম সালাহ উদ্দিনের ভবনটিতে আগুন দেন। এ সময় গণপিটুনিতে নিহত হন আরও ৮ জন।
অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ
নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান (১৯) লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। ছেলের কথা উঠলেই নাছিমা আক্তারের চোখ পানিতে টলমল করে। একমাত্র ছেলেটি নেই, তা যেন ভাবতে পারেন না তিনি। ঘরে থাকা ছেলের বই-খাতা, জামাকাপড়, জুতা—সবকিছুই যত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। এসব নিয়েই দিন কাটে তাঁর।
নাছিমা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেকে দিনের আলোয় গুলি করে মারল। এত দিনেও মূল আসামিরা ধরা পড়েননি, একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়নি, তাহলে বিচার কীভাবে হবে? কাদের হাতে অস্ত্র ছিল, পুরো দেশবাসী বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছে। কিন্তু পুলিশ তা উদ্ধার করতে পারছে না।’
গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের একজন খালেদ মাহমুদ। তিনি জানান, সেদিন হাসপাতালে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সারি সারি গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন। শত শত মানুষের জটলা, চিৎকার। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও কোমরে, কারও পিঠে গুলির চিহ্ন। পুরো হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘যারা প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখিয়ে গুলি চালাল, তাদের অস্ত্র যদি উদ্ধারই না হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে বিশ্বাস করবে যে তদন্ত ঠিকভাবে হচ্ছে।’
অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি রেজাউল করিম বলেন, ‘ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা গেছে কারা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরও ১৫ মাসে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়নি। এতে মনে হয়, মামলার তদন্তকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আটকে রাখা হচ্ছে। বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের ওপর যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি চালানো হলো, সেই অস্ত্রগুলো আজও উদ্ধার হয়নি। শত শত গ্রেপ্তার হচ্ছে, কিন্তু একটি অস্ত্রও পাওয়া যাচ্ছে না—এটি কীভাবে সম্ভব? জনগণ জানতে চায়, সেই অস্ত্র কেন উদ্ধার করা হয়নি।’
আমার ছেলেকে দিনের আলোয় গুলি করে মারল। এত দিনেও মূল আসামিরা ধরা পড়েননি, একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়নি, তাহলে বিচার কীভাবে হবে?—নাছিমা আক্তার, নিহত সাদ আল আফনানের মা।
থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রেরও হদিস নেই
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর ও রামগঞ্জ থানায় হামলা ও ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ লোকজন। এ সময় থানা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে অগ্নিসংযোগ করা হয় দুটি থানাতেই।
পুলিশ জানিয়েছেন, সে সময় থানার অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া ২৯টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এর মধ্যে ১৭টি থানায় জমা রাখা বেসরকারি অস্ত্র। এ ছাড়া ২ হাজার ৫০০ গুলিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
যা বলছে পুলিশ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে হতাহত করার মামলায় গত এক বছরে র্যাব-পুলিশের অভিযানে প্রায় ১৮০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান কাজেমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজে অনেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এখনো পাওয়া যায়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধারে কাজ চলছে।’
রায়হান কাজেমী আরও বলেন, ওই দিন যাঁদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তাঁদের অধিকাংশই তখনকার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। তবে মোট কতজন অস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তা শনাক্ত করা যায়নি। ভিডিও ফুটেজের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।