জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলেন দেড় হাজার গ্রাহক, ঘরে ঘরে আনন্দ

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলায় স্বাধীনতার ৫২ বছর পর পৌঁছেছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ। বৃহস্পতিবার নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ
ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার মানুষ জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার রাত নয়টা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের দেড় হাজার গ্রাহকের ঘরে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। এতে খুশি দেড় হাজার গ্রাহকের পরিবার। কিছুদিনের মধ্যে দ্বীপের ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ২০ হাজার গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর অর্থাৎ দীর্ঘ ৫২ বছর পর কুতুবদিয়া উপজেলার মানুষ সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় এটি সম্ভব হয়েছে। এত দিন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ দ্বীপবাসীর স্বপ্ন ছিল, এখন বাস্তব।

সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ বলেন, সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়াতে সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ায় দ্বীপে চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। এখানে গড়ে উঠছে নানা শিল্পকারখানা, মাছ সংরক্ষণের হিমাগারসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দ্রুত প্রসার ঘটবে পর্যটনের। দ্বীপে উৎপাদিত সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, লবণ, তরমুজ, পানসহ নানা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমদ। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এই দ্বীপ উপজেলায় বিদ্যুৎ ছিল না। ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যাকালীন দেড় হাজার গ্রাহককে কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ–সংযোগ নিশ্চিত করে। বৃহস্পতিবার থেকে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় হাজার গ্রাহককে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে দ্বীপের আরও ২০ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

উপজেলা প্রশাসন ও পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুতুবদিয়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার। দ্বীপের চতুর্দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ আছে ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো ভাঙা। একসময় পুরো উপজেলা চরধুরুং, উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ, আলী আকবর ডেইল, রাজাখালী, খুদিয়ারটেক নামে নয়টি মৌজায় বিভক্ত ছিল। এখনকার দ্বীপের মানচিত্রে খুদিয়ারটেক ও রাজাখালী মৌজা নেই।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে দ্বীপের মানুষের কাছে স্বপ্ন ছিল জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ–সংযোগ। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশ থেকে কেব্‌ল লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় অতীতে কোনো সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। এখন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পুরো উপজেলা আলোকিত হচ্ছে। এ জন্য কুতুবদিয়ার মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে দেশের শতভাগ বিদ্যুৎ–সুবিধার আওতায় ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ নামে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় এলাকার মানুষ ব্যাপক খুশি।

কুতুবদিয়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে টানা হয়েছে এমন বিদ্যুতের লাইন। সম্প্রতি উপজেলার বড়ঘোপ ইউনিয়নে
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ বলেন, কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাগরের তলদেশ থেকে দীর্ঘ ছয় কিলোমিটার কেব্‌ল টানতে হয়েছে। কুতুবদিয়াতে স্থাপন করা হয়েছে ১২ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন উপকেন্দ্র। পাশাপাশি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৭২০ কিলোমিটার সঞ্চালন বিতরণ স্থাপন হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে তিনটি সাবস্টেশন নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। হাতিয়া থেকে ১১ কেভি সাবমেরিন লাইনের মাধ্যমে নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।

নতুন স্বপ্ন, ঘরে ঘরে আনন্দ

কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল খালেকের বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। ঘরের লোকজন রঙিন টেলিভিশনে খবর দেখছেন। প্রতিবেশীরাও এসেছেন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে। তবে এখনো এ বাড়ির চারপাশের শতাধিক বাড়ি অন্ধকারে। আবদুল খালেক বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় এত দিন ঘরে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার ভালো সুযোগ পায়নি। এখন কম্পিউটারে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ–সংযোগ নিতে ইতিমধ্যে তাঁর আশপাশের কয়েক শ বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। গ্রাহক হতে অনেকে আবেদনও করে রেখেছেন। সহসা এসব ঘরেও আলো জ্বলবে।

উপজেলা সদরের মৎস্য ব্যবসায়ী জালাল আহমদ বলেন, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ হাতে আসায় অন্তত ৩৪ হাজার মৎস্যজীবী লাভবান হবেন। ইতিমধ্যে তিনিসহ কয়েকজন ব্যক্তি মৎস্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বিদ্যুৎ না থাকায় এত দিন এলাকায় আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ, পোলট্রি, মৎস্য খামার, শিল্প-কলকারখানা, কুটিরশিল্প গড়ে ওঠেনি জানিয়ে কুতুবদিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি লিটন কুতুবী বলেন, করোনা মহামারির সময় সারা দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস, পাঠদান ও পরীক্ষায় অংশ নিলেও কুতুবদিয়ার শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। দ্বীপের একমাত্র ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে রাতে কয়েক ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে চিকিৎসাসেবা চালানো হতো। জেনারেটর নষ্ট কিংবা বিকল হলে মোমের আলোয় চলত অস্ত্রোপচারসহ নানা চিকিৎসা। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ কুতুবদিয়ার চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। এ জন্য কুতুবদিয়ার মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।