রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ঈদের আমেজ নেই

কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য সমবেত হয়েছেন রোহিঙ্গারা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের একটি পাহাড়ে ঝুপড়ি ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে বসবাস রোহিঙ্গা সৈয়দ কামালের। গত বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রথম দিনে চালের রুটির সঙ্গে রান্না করা গরুর মাংস খেয়েছেন পেট পুরে। এবারে তা কপালে জোটেনি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে আশ্রয়শিবিরের মাঠে ঈদের জামাত শেষে বাড়িতে সবাই খেয়েছেন অল্প কিছু সেমাই। দুপুরে খেয়েছেন ব্রয়লার মুরগির সঙ্গে সাদা ভাত।

এবারের ঈদে সন্তানদের নতুন জামাকাপড়ও কিনে দিতে পারেননি সৈয়দ কামাল (৪৭)। ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশ্রয়শিবিরের ঝুপড়ি ঘরে ছয়টি বছর কেটে গেল, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঠিকানাবিহীন জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের আর কত দিন বিদেশের পাহাড়-জঙ্গলে পড়ে থাকতে হবে, তা কেউ জানে না।

মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস করে। এখানে ঈদের দিন চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস পরিবেশনের প্রচলন দীর্ঘদিনের। মিয়ানমারে থাকতেও এই প্রচলন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে আসার পর ছন্দপতন ঘটে। শুরুর দিকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে চাল, ডাল, তেল, জ্বালানিসহ রোহিঙ্গারা প্রতি মাসে মাথাপিছু ১২ মার্কিন ডলারের অনুদান পেত। সেই সহায়তা এখন কমে ৮ ডলারে ঠেকেছে। এ টাকায় সন্তানদের নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়া তো দূরের কথা, ঠিকমতো সংসারও চলে না।

মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবদুল মুনাফ বলেন, শরণার্থীদের কারও মধ্যে ঈদের আনন্দ নেই। ঈদের দিন ঘরে বসে অলস সময় পার করছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা।

পাশের কুতুপালং, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া, বালুখালী আশ্রয়শিবিরেও এক দৃশ্য। সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে রোহিঙ্গারা ঘরে ফিরে যান। আশ্রয়শিবিরের হাটবাজার, দোকানপাট-সড়ক অনেকটা ফাঁকা। প্রচণ্ড গরমে লোকজন না থাকায় দোকানপাটে বেচাবিক্রিও তেমন নেই।

টেকনাফের শালবাগান, জাদিমুরা, নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের চেহারাও মলিন। কারও মুখে হাসি নেই। সকাল থেকে কিছু রোহিঙ্গা শিশু আশ্রয়শিবিরের এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে ফিরলেও কেউ গরুর মাংসের সঙ্গে চালের রুটি খেতে পারেনি। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো যায়নি।

বালুখালী আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা আছে প্রায় ৮২ হাজার। গত বছরও কমবেশি সবার ঘরে মাংস-রুটির আপ্যায়ন ছিল। এবার হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারে আয়োজন রাখা হয়। কারণ, মাংসের দাম অনেক বেশি।

বালুখালী আশ্রয়শিবিরের শফি উল্লাহ (৫৬) বলেন, এবারের ঈদে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এত টাকায় গরু মাংস কেনার সামর্থ্য কারও নেই। আগে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন ঈদের খরচা হিসেবে টাকা পাঠাতেন; এবারের ঈদে তা–ও সম্ভব হয়নি। শফি উল্লাহ আরও বলেন, গরুর মাংসের সঙ্গে চালের রুটি খেতে না পারলে রোহিঙ্গাদের কাছে ঈদ ঈদের মতো হয় না।

টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে বাবা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন নবী আলম। ঈদের জন্য কিনেছেন সেমাই। সকালে সবাই মিলে খেয়েছেন সেমাই।
নবী আলম (৫০) বলেন, জাতিসংঘের সহযোগিতায় আশ্রয়শিবিরে চাল, ডাল, তেল, লবণসহ আনুষঙ্গিক সব সহযোগিতা পাওয়া গেলেও মনে শান্তি নেই। কখন মিয়ানমারে ফিরতে পারব, সেই নিশ্চয়তাও নেই।

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে ঈদের দিন রাস্তার ওপর শিশুদের খেলনাসামগ্রী নিয়ে বসেছেন এক ব্যবসায়ী
ছবি: প্রথম আলো

আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন গলিতে চলে রোহিঙ্গা শিশু–কিশোরদের আড্ডা-হইচই। কিছু শিশুর পরনে নতুন জামা, কারও পুরোনো। ঈদের সালামির টাকায় তারা দোকান থেকে চকলেট, চা-বিস্কুট, আচার-শরবত কিনে খাচ্ছে। তরুণ ও যুবকেরা দোকানপাটে আড্ডা এবং ক্যারম-লুডু খেলে সময় পার করছেন।