বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও অফিসে তালা, পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের অভিযোগ এনে বিক্ষোভ করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন একদল শিক্ষার্থী। একই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবন ও তাঁর কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বাসভবন ও কার্যালয়ে তালা দেন তাঁরা।
এর আগে বেলা তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন-১-এর নিচতলায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিলটি নিয়ে বাসভবনের সামনে প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় উপাচার্যের ছয়টি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানান তাঁরা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কৌশলে পুনর্বাসনের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন উপাচার্য। উপাচার্যের ছয়টি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো উপাচার্যের সুবিধার জন্য মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিস্ট্রারকে বহাল রাখা; বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আগাম জামিন পাওয়া; নিয়মবহির্ভূতভাবে দুজন সিন্ডিকেট সদস্যকে বাদ দিয়ে চিহ্নিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নিয়ে পাতানো গোপন সিন্ডিকেটের নাটক মঞ্চস্থ করা; বিশ্ববিদ্যালয় আইনের দোহাই দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের স্বপদে বহাল রেখে মূল পদে আনার পাঁয়তারা; গত ৬ মাসেও ২২ দফা বাস্তবায়নে উদ্যোগ না নেওয়া এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের অবাধ বিচরণ, মাদক সেবন ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা।
বিক্ষোভ চলাকালে সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্য শুচিতা শরমিন ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে পুনর্বাসন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের জন্য গোপনে সিন্ডিকেটের সভাও ডেকেছেন। আমরা অনতিবিলম্বে উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।’
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহযোগী রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে তাঁর পদে বহাল রেখে উপাচার্য তাঁর বলয় সৃষ্টি করছেন এবং জুলাই বিপ্লবের চেতনার পক্ষের শিক্ষকদের নানাভাবে হেনস্তা করছেন। একই সঙ্গে সম্প্রতি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে মিথ্যা অজুহাতে দুজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দিয়েছেন। সেখানে ফ্যাসিস্টের সহযোগী দুজন শিক্ষককে সিন্ডিকেট সদস্য করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই দুজন শিক্ষককে সিন্ডিকেট সদস্য করার জন্য উপাচার্য পাতানো গোপন সিন্ডিকেট সভার আহ্বান করেছেন।
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর শুচিতা শরমিন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর শিক্ষার্থীরা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে মুক্ত করতে ২২ দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন। উপাচার্য এসব দাবি বারবার সময় নিয়েও পূরণ করেননি। এ জন্য আমরা তাঁকে আর সুযোগ দিতে চাই না। উপাচার্য পদত্যাগ না করলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দেব।’
এ সময় আরও বক্তব্য দেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শারাফাত হোসেন সিফাত, রসায়ন বিভাগের রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব
শিক্ষার্থীরা জানান, গত বছরের ২৭ নভেম্বর উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে পদত্যাগের দাবি তুলে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। পরে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পদত্যাগ না করায় ২৮ নভেম্বর দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের ওই অংশ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অপর একটি অংশ উপাচার্যের পক্ষ নেওয়ায় এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বাগ্বিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয় দুই দল শিক্ষার্থীর মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে শিক্ষার্থীদের ২২ দফা দাবি বাস্তবায়নে উপাচার্য সম্মত হলে ওই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
শিক্ষার্থীরা জানান, নতুন করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ৬ ফেব্রুয়ারি পুনরায় আন্দোলনের সূচনা হয়। ওই দিন উপাচার্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এককভাবে দুজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে দুই বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই সিন্ডিকেট সদস্য পদ থেকে বাদ দেন। এ ঘটনায় উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন ভুক্তভোগী দুই শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, ওই দুই শিক্ষক হলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ উদ্দীন এবং সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, সিন্ডিকেট সদস্যদের দুই বছরের জন্য নির্বাচিত করা হয়। গত বছরের ৩০ এপ্রিল ৪৪তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় দুই বছরের জন্য ওই দুজন সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হন। ৬ ফেব্রুয়ারি ৪৯তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় তাঁদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উপাচার্য।
একাডেমিক কাউন্সিলের অন্তত চারজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের ৬ ফেব্রুয়ারির সভায় উপাচার্য ওই দুই শিক্ষককে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহযোগী আখ্যা দিয়ে তাঁদের এ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং তা নিজেই এককভাবে অনুমোদন করেন।
তবে সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া অভিযোগ করেন, উপাচার্যের ব্যক্তিগত পছন্দের লোক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সাবেক কোষাধ্যক্ষ কর্নেল (অব.) আবু হেনা মোস্তফা কামালের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। এ জন্য উপাচার্য ব্যক্তিগত ক্ষোভের বশে সিন্ডিকেট থেকে তাঁকে বাদ দিয়েছেন।
প্রশাসনের অপর একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ে উপাচার্য শুচিতা শরমিন ও সহ-উপাচার্য গোলাম রব্বানির মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের একাডেমিক অগ্রগতি জানতে চেয়ারম্যানদের সঙ্গে একটি সভা ডেকেছিলেন সহ-উপাচার্য। সহ-উপাচার্যের পক্ষে সহকারী রেজিস্ট্রার সাফিজ উদ্দিন ১০ ফেব্রুয়ারি সভার নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু উপাচার্য ওই দিনই সহ–উপাচার্যের নোটিশকে বিধিবহির্ভূত উল্লেখ করে সব বিভাগের চেয়ারম্যানকে এ ব্যাপারে সাড়া না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পাল্টা নোটিশ দেন। তাঁর পক্ষে রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম ওই নোটিশ জারি করেন। এ ঘটনার পর সহ-উপাচার্যের পক্ষে নোটিশ জারি করা সহকারী রেজিস্ট্রার সাফিজ উদ্দিনকে তাঁর দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়া দুই শিক্ষক ফরহাদ উদ্দীন, মোস্তাকিম মিয়া সহ-উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজ সন্ধ্যায় উপাচার্য শুচিতা শরমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া দেননি। উপাচার্য দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি গত তিন দিন বরিশালের বাইরে ছিলেন। আজ সকালে ক্যাম্পাসে ফিরেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও বুঝতে পারছি না, কেন হঠাৎ করে এমন দাবি তোলা হলো।’ তাঁর মেয়াদ শেষ হয়েছে, এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আমাকে সাড়ে চার বছর অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে রাখা হয়েছিল। উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে আমি স্বপদে ফিরি। এরপর আমার চাকরির মেয়াদ ১ ফেব্রুয়ারি শেষ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে বিধি অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চিঠি দিয়েছে এবং আগামী সিন্ডিকেটে এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে।’