স্বেচ্ছাশ্রমে ছয় বছর ধরে বন্য প্রাণী উদ্ধার

এখন সিউর সেবা-শুশ্রূষায় বড় হচ্ছে তিনটি মাছরাঙা এবং দুটি সবুজ টিয়ের ছানা। টিয়ের ছানা দুটিকে এখনো মুখে তুলে খাওয়াতে হয়।

টিয়া পাখির ছানাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সেবাশুশ্রূষায় বেড়ে উঠছে পাখিগুলো
ছবি: প্রথম আলো

একটি শালিক পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষক ও আলোকচিত্রী খোকন থৌনাউজম এবং সোহেল শ্যামের পরিচয় হয়। পরে দুজন মিলে গড়ে তোলেন বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও উদ্ধারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইফ (সিউ)’। এরপর যেখানেই বন্য প্রাণী বিপন্ন হয়েছে, খবর পেয়ে তাঁরা ছুটে গেছেন। তাঁরা প্রাণীটিকে সুস্থ করে মুক্ত পরিবেশে ছেড়েছেন। ছয় বছরে এই সংগঠন প্রায় ৪০০ বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছে।

খোকন থৌনাউজম গত শনিবার বলেন, শুধু আইন করেই পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। তবে আশার দিক হলো, ধীরগতিতে হলেও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির হারটা বেশি। তরুণেরা কখনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। কখনো নিজেরাই প্রাণী উদ্ধার করছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো গেলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির বিষয়ে সচেতন হয়ে বেড়ে উঠবে, যার সুফল হবে দীর্ঘমেয়াদি।

সিউর সদস্যরা বলেন, বন-পাহাড়, হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ মৌলভীবাজার বন্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। খোকন থৌনাউজম এবং সোহেল শ্যাম খবর পেলেই বিপন্ন প্রাণী উদ্ধার করে শুশ্রূষা করতেন। দুজনই থাকেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। তবে তাঁরা একে অপরকে চিনতেন না। ২০১৭ সালে একটি শালিক পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে তাঁরা দুজন পরিচিত হন। এরপর এ সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরও অনেকে। বর্তমানে সিউয়ের মাধ্যমে ১২ জন স্বেচ্ছাসেবী সরাসরি উদ্ধারকাজে যুক্ত আছেন। আরও অনেকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।

সিউর সদস্যরা বলেন, তাঁরা ছয় বছরের মধ্যে সাড়ে চার শতাধিক বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে আছে বিপন্ন প্রজাতির চিতা বিড়াল, মেছো বিড়াল, বনরুই, লজ্জাবতী বানর, বনবিড়াল, বিন্টুরং, বাঁশভালুক, হনুমান, ভুবন চিল, হট্টিটি, বালিহাঁস, কালেম, বনমোরগ, গোখরা সাপ, দাঁড়াশ, ফণীমনসা, কচ্ছপ ইত্যাদি। প্রাণীগুলো উদ্ধার করে কখনো বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছেন। কখনো তাঁরা নিজেরা প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছেন। এ মুহূর্তে সিউয়ের সেবা-শুশ্রূষায় বড় হচ্ছে তিনটি মাছরাঙা এবং দুটি সবুজ টিয়ের ছানা।

সোহেল শ্যাম বলেন, মাছরাঙার চারটি ছানা ছিল। একটি উড়ে চলে গেছে। বাকি তিনটি উড়তে শিখছে। উড়তে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। সবুজ টিয়ের ছানা দুটিকে এখনো মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। এদের উড়াল শিখতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগতে পারে।

সিউর সদস্যরা আরও বলেন, বন্য প্রাণী উদ্ধারের কাজটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের, অলাভজনক। শুরুতে স্বেচ্ছাসেবীদের পরিবারের সদস্যরাও সহজভাবে নেননি। কিন্তু এখন সহযোগিতাই মিলছে। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকেও তাঁদের সংগঠন সার্বিক সহযোগিতা পায়। কোথায় কোন প্রাণী ধরা পড়ল, আহত হলো ইত্যাদি তথ্য তাঁরা পেয়ে থাকেন নানা মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করছে। তাঁরা তথ্যটি জানার পর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে জানান। তাঁদের পক্ষে সম্ভব হলে নিজেরাই দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

সোহেল শ্যাম বলেন, সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের কুরমা এলাকায় পাখিশিকারিকে ধরে থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর এই এলাকায় কেউ আর পাখি শিকার করছেন না। তবে এ রকম ঘটনায় সাজা দিতে হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দরকার পড়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ ঘটনাস্থলে যাওয়া সময়সাপেক্ষ। শুধু বন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) এবং সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাজা প্রদানের ক্ষমতা থাকলে কাজটা সহজ হতো।

সোহেল আরও বলেন, ‘অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা পরিবেশ, বন্য প্রাণী আইন সম্পর্কে জানেন। সব জেনেও তাঁরা পাখির মাংস, হরিণের মাংস খান। মাংসের চাহিদা আছে বলেই শিকারিরা জেনে, না জেনে পাখি ও হরিণ শিকার করেন। আমরা চাই এমন সময় আসবে যখন প্রত্যেক মানুষ গাছের কথা, পাখির কথা, বন্য প্রাণীর কথা বলবে। আলাদা করে আর সংগঠনের প্রয়োজন পড়বে না।’

বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক শ্যামল কুমার মিত্র গত বৃহস্পতিবার বলেন, সিউর সদস্যরা বন্য প্রাণীর ভালোর জন্য কাজ করেন। তথ্য দিয়ে, অভিযানে সঙ্গে গিয়ে সহযোগিতা করেন। সিউয়ের সদস্যদের মতো সবাই সচেতন হলে তাঁদের জন্যও কাজটি সহজ হয়।