শয্যা না থাকায় আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গত বুধবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। উপজেলার বাইরে থেকেও রোগীরা আসায় চিকিৎসকদেরও হিমশিম অবস্থা। চালকের অভাবে অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা দুর্ভোগ পোহান।

কুমারী গ্রামের আবদুর রাজ্জাক বলেন, সম্প্রতি তাঁর এক নিকটাত্মীয় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তিনি তাঁকে প্রথমে আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে জরুরিভাবে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে বেশি টাকায় তাঁদের বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে হয়েছে। এতে অতিরিক্ত সময় ও টাকা ব্যয় হয়েছে। 

আলমডাঙ্গা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে হারদী গ্রামে ১৯৬২ সালে ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও চাহিদা অনুযায়ী জনবল বাড়ানো হয়নি। এতে এই হাসপাতালে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। 

৫০ শয্যার জনবল কাঠামো অনুযায়ী, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও), আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ (আরএমও) ২২টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি পদই শূন্য এবং ৩ জন চিকিৎসক প্রেষণে আছেন। এখানে ইউএইচএফপিও, আরএমও, গাইনিবিশেষজ্ঞ, অবেদনবিদ এবং ছয়জন সহকারী সার্জন কর্মরত আছেন। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের ৯টি পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য। এগুলো হচ্ছে চক্ষু, শিশু, শিশু (রেভিনিউ পারমানেন্ট), চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস, সার্জারি এবং নাক কান গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞের পদ। দেশের অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তার (ইএমও) তিনটি পদ থাকলেও এখানে সেই পদই নেই। 

এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (মেডিসিন) মাহবুবুর রহমান ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ও কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (কার্ডিওলজি) নূরে আলম আশরাফী ৩০ জুলাই থেকে সদর হাসপাতালে এবং চিকিৎসা কর্মকর্তা (হোমিওপ্যাথিক) ইমামুল ইসলাম গত বছরের ২৮ মার্চ থেকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেষণে আছেন। বর্তমানে নার্সিং সুপারভাইজারসহ ৩৪ জন জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্সের মধ্যে ২৭ জন কর্মরত আছেন। মিডওয়াইফের ৯টি পদের ৭টিই রয়েছে শূন্য। এখানে এক্স-রেসহ ১৬ ধরনের পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও আলট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি পরীক্ষার ব্যবস্থা আজও চালু করা হয়নি। এ কারণে জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রোগীদের ছুটতে হয় আলমডাঙ্গায়। 

গত মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের কক্ষগুলোর সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। এই সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগীদের প্রায় অর্ধেকই এসেছেন পাশের মেহেরপুরের গাংনী এবং কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁদের গড়ে প্রতিদিন ৫০০ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিতে হয়।

আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। গত বুধবার বিকেলে তোলা ছবি
প্রথম আলো

গত বুধবার বিকেলে জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো) ফারুক হোসেনকে একের পর এক রোগী সামলে চলেছেন। ভর্তি রোগীদের সামলাতে ওয়ার্ডগুলোতে জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্সদের বেগ পেতে হচ্ছে।

বুধবার বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৪ জন রোগী ভর্তি। তৃতীয় তলায় ১৬ শয্যার মহিলা ওয়ার্ডে ৩৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। শয্যা না থাকায় অধিকাংশ রোগী মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

উপজেলার হারদী গ্রামের রেখা খাতুন তাঁর অসুস্থ মা জরিমন বেগমকে (৭৫) ভর্তি করেছেন। তাঁকেও মহিলা ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে রাখা হয়েছে। রেখা জানান, সকালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। এখানে সব সময় সব রোগের ওষুধ পাওয়া যায় না। জরিমন বেগমের পাশেই মাদুর বিছিয়ে চিকিৎসা চলছিল কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ঝুটিয়াডাঙ্গা গ্রামের শাহিনুর বেগমের। শাহিনুর বলেন, ‘সকালে অ্যাকবার ডাক্তার আইয়েল। ইরপর সারা দিন দ্যাকা যায়নি।’ 

১২ শয্যার পুরুষ ওয়ার্ডে ১৬ জন রোগী ছিলেন। এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মিরপুর উপজেলার মাজিলা গ্রামের কিশোর মাহফুজ (১৭) জ্বরে আক্রান্ত। মাহফুজের মা সফেলা খাতুন বলেন, ‘তিন দিন ভত্তি। ডাক্তার দিনি একবার আইসে দেকে যায়। ওষুধও ঠিকমতো পাইনে। সকালে দুটো আর দুপোরে এট্টা বড়ি দিয়েচে। বাইরিত্তি (বাইরে থেকে) চারডে সিরাপ আর এট্টা বড়ি কিনিচি।’

 উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, সীমিত জনবল দিয়েই সাধ্যমতো সেবা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। জনবলসংকট, অ্যাম্বুলেন্সের চালক, কম্পিউটার অপারেটর না থাকা, ওষুধ সংকটসহ অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে প্রতি মাসেই সিভিল সার্জনকে লিখিতভাবে জানানো হয়।