মানুষের বিপদে ছুটে যেতেন মামুন, তাঁর শোকে কাঁদছে পুরো গ্রাম
দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে মামুন চতুর্থ। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পরিবারে অভাব-অনটন থাকায় এসএসসির পর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। ১১ বছর আগে শহরে পাড়ি জমান। সেখানে একটি চাকরি শুরু করেন। পরে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। নগরের সিডিএ মার্কেটে তাঁর একটি দোকান আছে। অল্প সময়ে ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেন এবং পরিবারের হাল ধরেন। বড় ব্যবসায়ী না হলেও মানুষের প্রয়োজনে ছুটে যেতেন। তাঁকে হারিয়ে তাই শোকাহত সাতকানিয়ার বারোদোনা গ্রামের মানুষ।
২৮ বছর বয়সী যুবক মো. মামুনকে বারোদোনা গ্রামের মৌলভিপাড়ার মানুষজন নিজেদের একান্ত আপন মনে করতেন। কারও মেয়ের বিয়ে, কেউ বিদেশে যাবেন আবার কেউ দেবে পরীক্ষা—এসব কাজে টাকার সমস্যা হলে সবার ভরসা ছিলেন মামুন। বিশাল ধনী ব্যবসায়ী না হলেও নিজের আয় থেকে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করতেন। সেই মানুষটির মৃত্যুতে কাঁদছে গোটা গ্রাম।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলন্ত মোটরসাইকেলকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দিলে সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে। এতে মোটরসাইকেলে থাকা মামুন, তাঁর বড় ভাই এবং মামার মৃত্যু হয়। মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলা অংশের পদুয়া ইউনিয়নের সিকদার দিঘিরপাড় এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত মামুন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভিপাড়ার ছিদ্দিক আহমদের ছেলে। এ ঘটনায় মামুনের বড় ভাই মো. হুমায়ুন (৩৫) এবং তাঁদের মামা করাইয়ানগর আকবরপাড়া গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে মনির হোসেনও (৪০) মারা যান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, মহাসড়কে চট্টগ্রামমুখী একটি মোটরসাইকেলকে গ্রামীণ সড়ক থেকে হঠাৎ উঠে আসা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দেয়। ধাক্কায় মোটরসাইকেলটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কক্সবাজারমুখী একটি মহিষবোঝাই ট্রাকের নিচে ঢুকে পড়ে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, ঘটনাস্থলেই দুজন মারা যান, আর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরেকজন।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে জানাজা শেষে মামুন ও তাঁর ভাই হুমায়ুনকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। একই রাতে করাইয়ানগর আকবরপাড়া গ্রামে তাঁদের মামা মনির হোসেনকে (৪০) দাফন করা হয়।
আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নে মামুনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নির্মাণাধীন একতলা পাকা বাড়ির বারান্দায় বসে ছিলেন দুই ছেলেকে হারানো সিদ্দিক আহমদ (৭০)। জানা গেল, বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। বৃদ্ধের দেখাশোনা করতেন ছোট ছেলে মামুন। দুর্ঘটনায় সিদ্দিক আহমদের দুই ছেলেই মারা গেছেন। শেষ বয়েসে এসে এই শোক তিনি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, সেটাই ভাবছিলেন স্বজনেরা।
বিলাপ করতে করতে সিদ্দিক আহমদ বলছিলেন, ‘আমার ছেলে আমার জন্য অনেক কিছুই করেছে। আমি তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এই দুঃখ আমি কাকে বোঝাব?’
ভেতরে শয়নকক্ষে বিলাপ করছিলেন মামুনের মা চেমন আরা (৬৫)। তাঁকে ঘিরে আহাজারি করছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। একসঙ্গে এত মানুষের আহাজারি আশপাশের পরিবেশকে ভারী করে তুলেছিল।
স্বজনেরা জানান, দুর্ঘটনায় নিহত মামুনের বড় ভাই হুমায়ুন স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তানের জনক। নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারে ছোট ব্যবসা ছিল তাঁর। তাঁদের মামা মনির হোসেন তিন মেয়ের জনক। সাতকানিয়া ও কেরানীহাটে ওষুধের ব্যবসা করতেন তিনিও। আর মামুন এখনো বিয়ে করেননি। জীবনে সংগ্রাম করে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। বাবা, মা ও বোনদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসার দায়িত্বও ছিল তাঁর। ৪ বছর আগে পাকা বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু সেটি এখনো অসম্পূর্ণ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে মামুন চতুর্থ। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পরিবারে অভাব-অনটন থাকায় এসএসসির পর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। ১১ বছর আগে শহরে পাড়ি জমান। সেখানে একটি চাকরি শুরু করেন। পরে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। নগরের সিডিএ মার্কেটে তাঁর একটি দোকান আছে। অল্প সময়ে ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেন এবং পরিবারের হাল ধরেন। মামুনের বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে ছেনু আরা নামে তাঁর এক প্রতিবন্ধী বোন আছেন।
মামুনদের বাড়িতে কথা হয় তাঁর বড় বোন জয়নাব বেগমের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি জানান, ভাই–বোনদের মধ্যে সবার ছোট রোকসানা আক্তারের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন মামুন। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে বাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ঠাকুরদিঘী বাজার এলাকায় ছোট বোনের হবু শ্বশুরবাড়ি দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন মামুন। ওই মোটরসাইকেলে আরোহী ছিলেন তাঁর ভাই হুমায়ুন ও মামা মনির। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমাদের এক প্রতিবেশী মুঠোফোনে দুর্ঘটনার সংবাদ জানান। মুহূর্তেই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আমরা সেখানে পৌঁছে কাউকে জীবিত দেখতে পাইনি।’
মামুনদের বাড়িতে জড়ো হয়েছেন তাঁর বন্ধু ও প্রতিবেশীরা। বাবা-মায়ের আহাজারি দেখে তাঁদের অনেকে চোখের পানি আটকাতে পারেননি। তাঁরা জানান, অসহায় মানুষের বন্ধু ছিলেন মামুন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, গরিব রোগী, দরিদ্র শিক্ষার্থীরা সাহায্যের জন্য ছুটে আসতেন তাঁর কাছে। এসব মানবিক কাজে গোপনে দান করে গেছেন এই তরুণ। সর্বশেষ গত সপ্তাহে এলাকার মানুষদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, খানাখন্দে বেহাল এলাকার সড়কটি নিজের অর্থায়নে সংস্কার করবেন এবং পথচারীদের সুবিধার্থে সড়কবাতি স্থাপন করবেন।
উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের এলাকাকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন মামুন। তাঁর এমন আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ। তাই তাঁর মৃত্যুর শোকে স্তব্ধ পুরো এলাকা।