অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার খবরে আসিফের গ্রামে উচ্ছ্বাস
কুমিল্লা শহর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। জেলার উত্তরের একটি উপজেলা মুরাদনগর। সেই উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের আকুবপুর গ্রাম এখন খুশির জোয়ারে ভাসছে। এই গ্রামের সন্তান আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হয়েছেন। পেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা মুরাদনগর। এই উপজেলার দৌলতপুর গ্রামেই জাতীয় কবির শ্বশুরবাড়ি। সেই গ্রাম থেকে পাকা সড়ক দিয়ে উত্তরে প্রায় ছয় কিলোমিটার এগোলে আসিফদের বাড়ি।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আকুবপুর গ্রামে আসিফদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দু-চারজন করে মানুষ আসছেন। তখন বৃষ্টি হওয়ায় বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তাটি ছিল কর্দমাক্ত। সেই কাদা মাড়িয়ে মানুষ আসিফদের বাড়ি দেখে কৌতূহল মেটাচ্ছেন। আশপাশের লোকজন জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা থেকে আসিফের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার খবর পাওয়ার পর বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এই বাড়িতে আসছেন। তাঁরা আসিফকে নিয়ে নানা গল্প করছেন।
গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আসিফের ছোট বোন ইফাত জাহান (লামিয়া)। বাড়িতে আসিফের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীরা ছিলেন। তবে আসিফের মা–বাবা এ সময় বাড়িতে ছিলেন না। তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় গেছেন। লামিয়ার কাছেই শোনা হয় তাদের পরিবার ও বড় ভাই আসিফের না জানা অনেক কথা।
লামিয়া জানায়, তাঁদের বাবা বিল্লাল হোসেন আকুবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা রোখসানা আক্তার গৃহিণী। তারা তিন বোন ও এক ভাই। বড় বোন নিশাত মনিরার বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে জাপানে থাকেন। ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় আসিফ। তৃতীয় ইশরাত জাহান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। সবার ছোট লামিয়া। সে ঢাকার হলিক্রস কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।
লামিয়া জানায়, ঢাকা থেকে ফোন পেয়ে গত বৃহস্পতিবার তাঁর বাবা ঢাকায় গেছেন। তার আগের দিন বুধবার ভাইকে দেখতে ঢাকায় যান তার মা রোখসানা আক্তার।
লামিয়া তাদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখায়। সে জানায়, তিন কক্ষের বাড়িতে আসিফ থাকেন দক্ষিণ পাশের কক্ষে। সেই কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তাকভর্তি বই। বাড়িতে এলে আসিফ বই পড়তেন। লামিয়া জানায়, গতকাল তাঁর বড় ভাই আসিফ যখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মনোনীত হন, তখন শত শত মানুষ তাঁদের বাড়িতে আসেন। বাজারে বাজি ফোটানো হয়। অনেকে মিষ্টি বিতরণ করেন। আজ সকাল থেকে গণমাধ্যমকর্মীর ভিড় বাড়িতে।
লামিয়া আরও জানায়, তার বড় ভাই আসিফ ছোটবেলা থেকে খুব মেধাবী। তবে মা–বাবা চাইতেন না তিনি রাজনীতি করুন। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল আসিফের। বাবার চাকরির সুবাদে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে শিশুশ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে নিজের গ্রামে আকুবপুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ঢাকায় চলে যান। ঢাকার তেজগাঁও হোসেন আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তারপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখন তিনি স্নাতকোত্তরের ছাত্র।
লামিয়া জানায়, ডিবি পুলিশ যখন তার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তার মা ও বাবা সারা দিন কাঁদেন। তাঁরা ঢাকায় যান। সেখানে ডিবি অফিস থেকে ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ তাঁর মা–বাবাকে চাপ প্রয়োগ করেন—হারুন যা যা শিখিয়ে দিয়েছেন, সেগুলোই যেন তাঁরা গণমাধ্যমে বলেন।
লামিয়া আরও জানায়, তার বড় ভাই আসিফ ছোটবেলা থেকে খুব মেধাবী। তবে মা–বাবা চাইতেন না তিনি রাজনীতি করুন। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল আসিফের।
লামিয়া আরও জানায়, ৫ আগস্ট আসিফ শাহবাগে যাওয়ার পথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন মুহুর্মুহু গুলি করে। আসিফের সামনেই দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সে দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন লামিয়া।
এদিকে আসিফের জন্য তাঁর গ্রামের বাড়ির মসজিদে দোয়ার আয়োজন করা হয়। মোহাম্মদ মোস্তফা নামে একজন জানান, জুমার নামাজের পর মসজিদের খতিব আসিফের জন্য দোয়া করেন।
আসিফের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী ফিরোজা বেগম জানান, আসিফ মাঝেমধে৵ বাড়িতে আসতেন। তবে বেশি দিন থাকতেন না, আবার ঢাকায় চলে যেতেন। আসিফ বাড়িতে এলে তাঁর ছেলে মহিউদ্দিনের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। খুব ভালো ছেলে আসিফ। আসিফের আরেক চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, আসিফের যখন খবর নেই, অনেকে বলছিলেন আসিফকে গুম করা হয়েছে। তখন তিনি সান্ত্বনা দেন। আসিফ যখন ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হন, তখন আসিফের মা–বাবা স্বস্তির নিশ্বাস নেন।
আসিফের চাচাতো ভাই মনির হোসেন বলেন, আসিফ খুব ভদ্র ও মেধাবী ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আসিফ প্রতিবাদী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন না। তিনি আশা করেন, আসিফ তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন।
এদিকে আসিফের বাড়িতে আসা স্থানীয় লোকজন বলেন, আসিফ এখন সরকারের উপদেষ্টা। এবার অন্তত কুমিল্লা নামেই বিভাগ হতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
আকুবপুর বাজারের কয়েকজন যুবক জানান, তাঁরা আসিফকে সংবর্ধনা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আসিফ যেদিন কুমিল্লায় আসবেন এবং তাঁদের সময় দেবেন, সেদিন তাঁরা আসিফকে সংবর্ধনা দেবেন।