নিখোঁজের দুই বছর পর যেভাবে উদ্ধার হলো মাফিজুলের লাশ

নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় বালিকা মাদ্রাসার শৌচাগারের মেঝে খুঁড়ে প্রায় ৭ ফুট নিচ থেকে মাফিজুলের লাশ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোববার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

দুই বছর দুই মাস আগে নিখোঁজ হন নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার খলিফাপাড়া মহল্লার মাফিজুল ইসলাম (২৫)। মা–বাবাসহ স্বজনেরা ছেলে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু একটি ঘটনার জেরে পরিবারটি জানতে পারে মাফিজুল খুন হয়েছেন।

আজ রোববার দুপুরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে মাফিজুলের বস্তাবন্দী লাশের হাড়গোড় উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আরও পড়ুন

রোববার গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় বালিকা মাদ্রাসার শৌচাগারের মেঝে খুঁড়ে প্রায় ৭ ফুট নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান শাকিলের নেতৃত্বে এ অভিযান চলে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে খননকাজ শেষে মাফিজুলের হাড়গোড় প্রকাশ্যে আনা হয়। ময়নাতদন্ত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেগুলো সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। মাফিজুলের পরা শার্ট-প্যান্ট শনাক্ত করেন তাঁর চাচাতো ভাই শেখ ফরিদ। মরদেহটি হাঁটু ভেঙে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে গভীর গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিল।

যেভাবে লাশ উদ্ধার

পুঁতে রাখা লাশ উদ্ধারে আসামিদের ঘটনাস্থলে আনা হয়। পরে তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে মাফিজুলের লাশ উদ্ধার করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল শনিবার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানাজানির পর জানা যায়, মাফিজুলের লাশ শহরের চাঁচকৈড় পুরানপাড়া মহল্লার একটি বালিকা মাদ্রাসার সেপটিক ট্যাংকের পাশে পুঁতে রাখা হয়েছে। খবর পাওয়ার পর থেকে গতকাল দিনভর ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী আবু তাহের খলিফা (৫৫), তাঁর মেয়ে তানজিলা খাতুন (২৮) ও তাঁর সাবেক স্বামী আল হাবিব সরকারকে (৩৫) আজ বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয়। পরে তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া জায়গা খুঁড়ে মাফিজুলের লাশ উদ্ধার করা হয়।

তবে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আরেক আসামি আশরাফুল ইসলামকে (৪২) ঘটনাস্থলে আনা হয়নি। আনুষ্ঠানিকতা শেষে হত্যাকাণ্ড নিয়ে মাদ্রাসা মাঠে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) এ টি এম মাইনুল ইসলাম। তিনি হত্যাকাণ্ডের কারণ উল্লেখ করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

পরকীয়ার দ্বন্দ্বে খুন ও লাশ গুম

মাফিজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ টি এম মাইনুল ইসলাম বলেন, একটি বেকারিতে কাজ করার সময় তানজিলার সঙ্গে মাফিজুলের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানতে পেরে তানজিলার স্বামী আল হাবিব ও বাবা আবু তাহের খলিফা ক্ষুব্ধ হন। পথের কাঁটা সরাতে তাঁরা মাফিজুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে তানজিলাকে চাপ দিয়ে মুঠোফোনে বাড়িতে মাফিজুলকে ডেকে নেন। শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে বাড়ির পাশে মাদ্রাসায় নিয়ে মাঠের দক্ষিণ পাশে শৌচাগারের ভেতর বস্তাবন্দী লাশ পুঁতে রাখেন। তাহের খলিফা মাদ্রাসার নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করায় কাজটি নির্বিঘ্নে করতে পেরেছিলেন।

যেভাবে হত্যার রহস্য উন্মোচন

মাফিজুলকে হত্যার পর তানজিলা-আল হাবিবের সংসারে টানাপোড়েন দেখা দেয়। পারিবারিক কলহের জেরে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে আল হাবিবের বিরুদ্ধে নির্যাতন, যৌতুক দাবিসহ অন্তত চারটি মামলা করেন তানজিলা। মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নাটোর কারাগারে যান হাবিব। সেখানে মাফিজুলের এক প্রতিবেশী জাকির মুন্সির সঙ্গে হাবিবের পরিচয় হয়। ক্ষোভ-কষ্টের কথা বলতে গিয়ে হাবিব তাঁর কাছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বলে ফেলেন। সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাকির মুন্সি গ্রামে ফিরে মাফিজুলের পরিবারকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খুলে বলেন। তখনই ঘটনাটি প্রকাশ পায়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ টি এম মাইনুল ইসলাম বলেন, ছেলে নিখোঁজের পর মা মাহিনুর বেগম ২০২২ সালের ৭ মে গুরুদাসপুর থানায় একটি জিডি করেছিলেন। দুই বছর পর হত্যার বিষয়টি জানার পর গত শুক্রবার রাতে মাহিনুর বেগম বাদী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় তানজিলার স্বামী আল হাবিব, বাবা আবু তাহের খলিফা ও আশরাফুল ইসলামের নাম উল্লেখসহ তিন-চারজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করেন। পুলিশ শুক্রবার রাতে তাহের খলিফা, শনিবার সকালে তানজিলা এবং আশরাফুলকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে আটক করে র‍্যাব। আসামিরা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।

গতকাল শনিবার থেকে আসামিরা রিমান্ডে আছেন বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান। ব্রিফিংয়ে অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) শরীফুল ইসলাম ও গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজ্জ্বল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের গুরুদাসপুরের ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম খননকাজে সহযোগিতা করেন।

মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যা বলছে

লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের ব্রিফিং। রোববার দুপুরে গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় মাদ্রাসা মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

রোববার লাশ উদ্ধারের সময় মাদ্রাসামাঠে সুপারিনটেনডেন্ট এমদাদুল হক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি আতিয়ার রহমান উপস্থিত ছিলেন। এমদাদুল হক জানান, ১৯৯৭ সাল থেকে নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করছেন তাহের খলিফা। রাতে মাদ্রাসার সিঁড়ির বারান্দায় ঘুমাতেন। দুই বছর আগে হত্যাকাণ্ডের পরও একইভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে কখনো বিমর্ষ দেখা যায়নি। তিনি এমন কাজ করতে পারেন, তাঁরা ভাবতে পারছেন না। তিনি হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আতিয়ার রহমান বলেন, মাদ্রাসার শৌচাগার থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। ছাত্রী, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক বেগ পেতে হবে।

এদিকে লাশ তোলা ঘিরে রোববার সকাল থেকেই শত শত মানুষকে মাদ্রাসার চারপাশে অবস্থান করতে দেখা গেছে। অনেকে আশপাশের বাসাবাড়ি ও মসজিদের দোতলায় উঠেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। লাশ তোলার সময় আসামিদের ঘটনাস্থলে নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তবে আসামিরা ছিলেন নির্বাক।