বোরো খেতে আঙ্গুরী বেগমের হাড়ভাঙা খাটুনি, পড়ালেখা শেখাতে চান তিন সন্তানকে

বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলছেন আঙ্গুরী বেগম। শনিবার সকালে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মাঘের সকাল, কনকনে ঠান্ডা। আকাশে সবে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে বসে ফসলের মাঠ থেকে ধানের চারা তুলছেন আঙ্গুরী বেগম (৪০)। দক্ষ কৃষকের মতো দ্রুত চলছে তাঁর হাত। বর্গা নেওয়া জমিতে ধানের চারা তিনি নিজেই রোপণ করবেন। বোরো মৌসুমে চাষাবাদে আঙ্গুরী বেগমের ব্যস্ত সময় কাটছে।

আঙ্গুরী বেগম জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা এলাকার মকবুল হোসেনের স্ত্রী। এ দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলে সপ্তম শ্রেণি এবং ছোট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ইজিবাইকচালক স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগানো কঠিন হয়ে যায়। তাই সন্তানদের লেখাপড়া করাতে ফসলের মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আঙ্গুরী। তাঁর ভাষ্য, সন্তানেরা লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে, শেষ বয়সে তাঁরা সুখে–শান্তিতে থাকবেন।

শনিবার সকালে আঙ্গুরী বেগমের সঙ্গে ফসলের মাঠে কথা হয়। মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা সড়কের দুই পাশে বিশাল ফসলের মাঠ। কেউ জমি প্রস্তুত করছেন, কেউ বীজতলা থেকে চারা তুলছেন। মাঠে বেশির ভাগই পুরুষ। তাঁদের মধ্যে চোখে পড়ে একজন নারীকেও। তিনি বীজতলা থেকে চারা তুলছেন। তিনিই আঙ্গুরী বেগম। সড়কের পাশের একটি খেত থেকে আঙ্গুরী ধানের চারা তুলছেন। পাশে বসে আছে আট বছরের মেয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে খেতেই হাজির স্বামী মকবুল হোসেন। তাঁরা দুজন সংগ্রামী জীবনের গল্প বলতে শুরু করলেন।

আঙ্গুরী বেগম দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষক বাবার টানাটানির সংসার। ছোট থেকেই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন কেটেছে আঙ্গুরীর। অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়। তবে বিয়ের সালটি তাঁর মনে নেই। আঙ্গুরীর ধারণা, প্রথম সন্তান হওয়ার দুই–তিন বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁর প্রথম সন্তানের বয়স এখন ১৭। এত বছরেও সুখের মুখ দেখতে পাননি তিনি। স্বামীর সংসারে এসেও তাঁর সংগ্রামী জীবন শেষ হয়নি।

আঙ্গুরী বেগম জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচা এলাকার মকবুল হোসেনের স্ত্রী। এ দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলে সপ্তম শ্রেণি এবং ছোট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

মকবুল হোসেন ইজিবাইক চালান। সেই আয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসারের খরচের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। গ্রামের একজনের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছেন আঙ্গুরী বেগম। তিনি মাঠের সব কাজ নিজেই করেন, শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর।

বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলতে তুলতে আঙ্গুরী বেগম বলেন, ‘বাপু, কষ্ট মানে, তিনডে মেয়ে-ছেলে, (তিন সন্তান) এডা (একটা) কলেজে পড়ে, সবার দোয়ায়। আর পোনায়ের বাপের (সন্তানের বাবা) অসুখ, অসুখই ছাড়ে না, অটো চালায় (ইজিবাইক), অনেক রকমের রুগ (রোগ) আছে। এই কষ্ট কইরা কোনো রহমে দিন যায়। আমি নিজেই খেতের সব কাজ করি। নিজের এক কড়া (এক শতাংশ) জমিও নাই। এল্যাহ (একটু) বাড়িভিটা আছে। বাগি-আদি (বর্গা) চাষ করি। জমি কিনার টেহাপয়সাও (টাকা) নাই। বিয়ের পর থেহেই (থেকে) কষ্ট করতেছি।’

আঙ্গুরী বেগম আরও বলেন, ‘পোনায়ের বাপে আগে রিকশা চালাইছে। কিস্তিতে টেহা তুলছিলাম। ওই টেহায় অটো কিনে দিছিলাম। এহন (এখন) ঋণ পরিশোধ করছি। এহন আর ফ্যাছাতের (ঝামেলা) মধ্যে যাই না। চারডা নিয়ে আইলে খাই, না নিয়ে আইলে উপোস পারি। অটোর ব্যাটারি গেছে গা। টেহার জন্যে ব্যাটারিও কিনতে পাইতেছি না।’

সন্তানরা যাতে আমগরে মতো কষ্ট না করে, তাই নিজেরা কষ্ট করি, ওগরে (সন্তান) কষ্ট করতে দেই না। ওগরে মেলা শিক্ষিত করতে চাই। যাতে ওরা (সন্তান) নিজেরা সুখে থাকে এবং আমগরেও সুখ দেয়।
আঙ্গুরী বেগম, কৃষাণী

সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে আঙ্গুরী বলেন, ‘বড় মেয়েডা ইন্টার (এইচএসসি) পরীক্ষা দিব। ছেলেডা সেভেনে আর সবার ছোট মেয়েডা টুয়ে পড়ে। এগরে খরচ জোগায়। খাই না–খাই ওগরে পড়ার খরচ ঠিকই দেয়। হুনেন (শুনেন), বাপের ঘরেও কষ্ট করছি, স্বামীর ঘরেও খালি কষ্টই করলাম, সুখ তো চোখেও দেখলাম না। সন্তানরা যাতে আমগরে মতো কষ্ট না করে, তাই নিজেরা কষ্ট করি, ওগরে (সন্তান) কষ্ট করতে দেই না। ওগরে মেলা শিক্ষিত করতে চাই। যাতে ওরা (সন্তান) নিজেরা সুখে থাকে এবং আমগরেও সুখ দেয়।’

মকবুল হোসেন রোগশোকে ভুগছেন, খেতের কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না, কোনো রকমে ইজিবাইক চালান। তিনি বলেন, ‘পৈতৃকসূত্রে দুই শতাংশ জমি আছে। আর কোনো জমিজমা নাই। অটো চালিয়ে যা আয় করি, সেই টাকায় চলে না তো। ওই যে পোলাপানদের মা অনেক কষ্ট করে। নিজেই কিছু জমি বাগি (বর্গা) নিয়েছে। দুজনে মিলে কষ্ট করি। তাই কোনো রকমে বাঁইচা আছি। দেহুন, সব সদাইপাতির (নিত্যপণ্য) যে দাম। গাড়ি চলাইয়ে যে কইডা টেহা পাই, সদাইপাতি কিনতেই শেষ হয়। তিনডা পোলাপান পড়ে। ওর (স্ত্রী) মতো আমারও ইচ্ছা, পোলাপানগুলা যাতে অনেক পড়ে। ওরা (সন্তান) যাতে চাকরি করে, অনেক ভালো থাকে।’