১৬ বছর ধরে ঝোপজঙ্গলে বসবাস মুজিবুরের

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মাশিকাড়া গ্রামের বাঁশঝাড়ের নিচে খুপরিতে মুজিবুর রহমান। আজ রোববার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সময়টা ছিল ২০০৭ সাল। ভাইদের কাছ থেকে বাবার সম্পত্তি না পেয়ে অভিমান করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মুজিবুর রহমান। এরপর কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার নিজ গ্রাম মাশিকাড়ার ঝোপজঙ্গলে ঘেরা বাঁশঝাড়ে পলিথিন দিয়ে খুপরি করে তাতেই বসবাস শুরু করেন। কখনো নুন–আলু দিয়ে ভাত খান, কখনো শুকনো খাবার খেয়ে, কখনো অনাহারে–অর্ধহারে তাঁর দিন কাটে। এখন তাঁর বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। চোখে সমস্যা। এক বুক অভিমান নিয়ে তিনি বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন খুপরিতে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুজিবুরের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে আজ রোববার দুপুরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা মুজিবুরের খুপরিতে যান। এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যান চিকিত্সার জন্য তাঁকে ১০ হাজার টাকা দেন।

মাশিকাড়া গ্রামের উত্তরপাড়ার মৌলভীবাড়ির বিশাল একটি জঙ্গলের ঝোপ-বাঁশঝাড় পেরিয়ে গিয়ে দেখা যায়, পলিথিনে মোড়ানো ছাউনির একটি ছোট খুপরিতে বসে আছেন ৬০ বছর বয়সী চিরকুমার মুজিবুর। দুপুরে প্রশাসনের লোকজন আসার খবর পেয়ে বেরিয়ে আসেন খুপরি থেকে। এরপর কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে জীবনের গল্প শোনালেন মুজিবুর।

ক্ষোভ, অভিমান আর কখনো কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সাজানো সংসার ছিল আমাদের। সৎভাইয়েরা পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করায় আমাকে জঙ্গলেই ঠাঁই নিতে হয়েছে। জঙ্গলের খুপরিতে থাকায় বিয়েটাও করতে পারিনি।’

মুজিবুর রহমান দাবি করে বলেন, ‘আমার বাবা লাল মিয়া প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন আমার মাকে। এ সংসারে মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। প্রথম সংসারে দুই ভাই ফরিদুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলাম। দ্বিতীয় সংসারে আমি মুজিবুর রহমান। বাবা লাল মিয়া রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সৎভাই ফরিদুল পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করতেন।’ মুজিবুর কাঁচপুর মালেক জুট মিলে চাকরি করে জহিরুলকে বিএ পাস করান। সেই জহিরুলই তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির ১০৫ শতাংশ জমির মধ্যে ৮৫ শতাংশ জমি লিখে নেন। তাঁকেও বাড়ি থেকে বের করে দেন।

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ২০০৭ সাল থেকে জঙ্গলে খুপরি বানিয়ে ঠাঁই নিই। বিয়ে করলে বউ রাখার ঘর নেই। তাই বিয়েটাও করতে পারিনি। মিলের চাকরি ছেড়ে বাড়িতে এসে ইলেকট্রিকের কাজ শুরু করি, বাঁ চোখটিও তখন নষ্ট হয় গেছে। বয়স হয়েছে, এখন কাজে নিতে চায় না কেউ। অর্ধাহারে, অনাহারে, রোদ, ঝড়বৃষ্টিতে, শেয়ালের হাঁকডাকের মধ্যেই খুপরিতে থাকি। কখনো লাকড়ির চুলায় ভাত আর আলু সেদ্ধ করে লবণ মরিচ দিয়ে খাই, কখনো শুকনা খাবার খেয়ে থাকি।’

মুজিবুর আপসোস করে বলেন, ‘সাপ-বিচ্ছু-মশা আমার ক্ষতি করেনি, মানুষ যা করেছে।’

মুজিবুর একটানা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানার কাছে তাঁর ১৬ বছরের দুঃখগাথা প্রকাশ করেন।

এ ব্যাপারে মুজিবুরের ভাই জহিরুলকে ফোন করেও তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জহিরুলের বড় ভাই ফরিদুলের ছেলে আল আমিন বলেন, ‘আমার কাকা অভিমানী। আমার দাদার জায়গাজমি ভাগ হয়নি এখনো। চাচার পাওনা বুঝিয়ে দিতে আমাদের আপত্তি নেই।’

স্থানীয় গুনাইঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি।

জানতে চাইলে সন্ধ্যায় ইউএনও নিগার সুলতানা বলেন, ‘মুজিবুরকে তাঁর পিতার জমির কাগজপত্র নিয়ে এসি ল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে তাঁর পাওনা জমি তাঁকে উদ্ধার করে দেওয়া হবে। না হয় আবাসনের ব্যবস্থা করে দেব। তাঁর অবস্থা খুবই নাজুক। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব তাঁকে ১০ হাজার টাকা চিকিত্সার জন্য দিয়েছেন। আমরাও তাঁকে সহযোগিতা করব।’

উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ পায়। পরে ইউএনওসহ আমরা মুজিবুরের খুপরির কাছে যাই। তাঁকে বের করে আনি। তাঁর গল্প শুনি। পরে চিকিত্সার দায়িত্ব নিয়েছি। নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছি তাঁকে।’