মধুপুরের প্রাকৃতিক বন হুমকিতে

বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, মধুপুরে ১৯ হাজার ১২৮ দশমিক ৯৮ একর বনভূমি বেদখল হয়েছে। এ ছাড়া বনের জমির মধ্যে অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে বনের জমিতে আনারসের চাষ হচ্ছে। সম্প্রতি কুড়াগাছা ইউনিয়নের ভবানীরটিকি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার প্রাকৃতিক বন হারিয়ে যাচ্ছে। এ উপজেলায় বর্তমানে মোট বনাঞ্চলের ১৫ ভাগেরও কম এলাকায় প্রাকৃতিক বন টিক রয়েছে। বনভূমির অনেক এলাকা এখন দখল হয়ে গেছে। সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। অনেক এলাকাজুড়ে চাষ হচ্ছে কলা-আনারসসহ বিভিন্ন ফলের। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই যে কয়েক দশক আগেও এখানে ছিল শাল-গজারির প্রাকৃতিক বন।

স্থানীয় লোকজন বলেন, বন বিভাগ দখল হওয়া বনভূমি উদ্ধার করছে প্রতিবছর। কিন্তু সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে লাগানো হচ্ছে বিদেশি প্রজাতির গাছ। ফলে প্রাকৃতিক বন দিন দিন সংকুচিত হতে হতে এখন শেষ পর্যায়ে।

টাঙ্গাইলের কুমুদিনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক (প্রভাষক) সাধন চন্দ্র দাস জানান, মানুষের কোনো ধরনের সাহায্য ছাড়াই প্রকৃতির নিয়মে যে বনের সৃষ্টি হয় তাকেই প্রাকৃতিক বন বলা হয়।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, মধুপুর উপজেলায় মোট বনভূমি রয়েছে ৪৫ হাজার ৫৬৫ একর। এর মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ৭৫৬ একর জমিতে রয়েছে প্রাকৃতিক বন রয়েছে, যা মোট বনভূমির ১৪ দশমিক ৮২ ভাগ। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, মধুপুরে ১৯ হাজার ১২৮ দশমিক ৯৮ একর বনভূমি বেদখল হয়েছে। এ ছাড়া বনের জমির মধ্যে আঞ্চলিক মহাসড়কসহ অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে।

১৫ মার্চ মধুপুর গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সদর থেকে ৮-১০ কিলোমিটার উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে বনাঞ্চল শুরু। পঁচিশমাইল নামক স্থান থেকে রসুলপুর পর্যন্ত টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার পথ যেতে রাস্তার পাশে প্রাকৃতিক বন দেখা যায়। এ ছাড়া রসুলপুর থেকে দোখলা পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে গজারিগাছ, আজুলি, বহেরাসহ বিভিন্ন বড় গাছের দেখা পাওয়া যায়। লম্বা ও মোটা শালগাছের নিচে ছোট ছোট অনেক গাছ এবং লতাগুল্মের ঝোপ দেখা যায়। এই এলাকাগুলো ছাড়া অন্য জায়গায় প্রাকৃতিক বনের দেখা মিলে না। 

পীরগাছা, হাগুরাকুড়ি, জয়নাগাছা, সাইনামারি, আমলিতলা, ঘুঘুরবাজার, অরণখোলা, গাছাবাড়ি, ভবানীরটিকি, জলছত্রসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রাকৃতিক বনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এসব এলাকায় একরের পর একর কলা, আনারস, পেঁপেসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির বাগান। কিছু দূর পরপর গ্রামীণ ছোট ছোট বাজার। মানুষের বাড়িঘরে ভরা পুরো এলাকা। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা কোনো বনভূমি। দেশের অন্য ১০টি এলাকার গ্রামের মতোই একেকটি গ্রাম। যেখানে পাকা রাস্তা, বৈদ্যুতিক লাইন—সব রয়েছে। বাস, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান—সব চলছে।

পীরগাছা তেমাথা বাজারে ওই এলাকার বাসিন্দা শালবিন মাংসাং বলেন, ‘আগে পুরো এলাকায় ছিল গজারির বন। দেখতে দেখতে বন উজাড় হয়ে গেল। এখন বনও নাই, বন্য প্রাণী নাই। আস্তে আস্তে বন শহর হইয়া যাইতাছে।’

বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ৫৬০ হেক্টর বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে স্থানীয় লোকদের অংশীদারত্বে বনায়ন করা হয়েছে। দ্রুতবর্ধনশীল আকাশমণিগাছ লাগিয়ে উদ্ধার করা ভূমি বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে।

উদ্ধার করা কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানে আকাশমণির বাগান। স্থানীয় লোকজন ওই সব বাগানে গাছের চারার ফাঁকে চাষবাদও করছেন। কয়েকজন জানান, আকাশমণির বাগানে বন্য প্রাণীদের খাবারের কোনো উপকরণ যায় না। এ গাছের নিচে লতাপাতা জন্মায় না। তাই এই গাছ লাগানোর কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, বনভূমির বড় একটি অংশ জবরদখল হয়ে আছে। প্রতিবছর কিছু কিছু ভূমি উদ্ধার করা হচ্ছে। বনের ভেতর বসবাসকারীদের দখলে থাকা বনভূমি উদ্ধার করতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। 

মো. সাজ্জাদুজ্জামান আরও বলেন, আকাশমণিগাছ দ্রুত বাড়ে। তা ছাড়া এ গাছ গরু–ছাগল খায় না। তাই উদ্ধার করা বনভূমিতে আকাশমণিগাছ লাগানো হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, বন বিভাগ যেসব জমি উদ্ধার করছে সেখানে শাল-গজারির চারা রোপণ করে প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিদেশি প্রজাতির গাছ দিয়ে যে বাগান করা হচ্ছে, তাতে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।