প্রতিষ্ঠার ১২ বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক একজন

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

কীর্তনখোলা নদীর তীরে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে গড়ে ওঠা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যুগ পূর্তি উদ্‌যাপিত হচ্ছে আজ বুধবার। গেল ১২ বছরে অনেক সম্ভাবনা আর সাফল্য এলেও নানা সংকটের কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বরিশালের সচেতন নাগরিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০০৯ সালে সংসদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছরই নতুন নতুন বিভাগ চালু হচ্ছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, পাশপাশি বাড়ছে নানামুখী চাহিদা। কিন্তু সেসব চাহিদা পূরণে অবকাঠামোসহ অন্যান্য উন্নয়ন পিছিয়ে আছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, নানা সংকটের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক না থাকায় শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আবাসন, পাঠদান কক্ষ, পরিবহন ও গ্রন্থাগারে বইয়ের সংকটও ব্যাপক।

বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯ জন শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে মাত্র ১ জন অধ্যাপক, ৪৬ জন সহযোগী অধ্যাপক কর্মরত। বাকিরা সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর নতুন নতুন বিভাগ খোলা হলেও নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আছেন মাত্র একজন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকস্বল্পতা যেমন আছে, তেমনি নেই সহ–উপাচার্য, স্থায়ী রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ পাঁচটি অনুষদের ডিন।

ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি করে চারটি আবাসিক হল থাকলেও সেখানে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। ফলে আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে থাকতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ লাভের অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্ম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণা কার্যক্রম খুব কম হচ্ছে। ১৯৯ জন শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই গবেষণা করছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারজন শিক্ষক বলেন, এক যুগ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমে কোনো গতি আনা যায়নি। গবেষণা খাতে বরাদ্দও সীমিত। এর মধ্যেও শিক্ষকেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণাকাজে অংশ নিচ্ছেন। তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের গবেষণাকাজে সম্পৃক্ত না করা গেলে শিক্ষার মান বৃদ্ধির করার উপায় নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে আবাসন সুবিধা আছে হাজারখানেকের কিছু বেশি শিক্ষার্থীর। ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি করে চারটি আবাসিক হল থাকলেও সেখানে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। ফলে আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে থাকতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। এতে যেমন তাঁদের আর্থিক ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ, তেমনি পরিবহন, অন্যান্য ব্যয় গুণতে হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬টি অনুষদের অধীন ২৫টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ১৮টি বাস আছে। তবে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য এ সুবিধা খুবই অপ্রতুল। পরিবহন–সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের বরিশাল নগর থেকে বাসে কিংবা অন্য গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে পথেঘাটে প্রায়ই হেনস্তার ঘটনা ঘটছে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া জাহান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও অনেক সংকট রয়ে গেছে। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ–সংকট আছে। একটি ক্লাসরুম দুটি বিভাগকে আবার কখনো কখনো আরও বেশি বিভাগকে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। একটি বিভাগের পাঠদান শেষ না হতেই আরেকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসে বাইরে অপেক্ষায় থাকেন। এটা শিক্ষার্থীদের জন্য বিড়ম্বনার বিষয়।

গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের ৪ বছরে ৩২টি কোর্স করতে হয়। এসব কোর্সের অধিকাংশ বই আমাদের গ্রন্থাগারে নেই। অনলাইনে বিদেশি জার্নাল ঘেঁটে পড়াশোনা করতে হয়। ইন্টারনেটের বিভিন্ন আর্টিকেলই একমাত্র রিসোর্স।’

অবকাঠামো ও অন্যান্য নানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ছাদেকুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভবন দরকার। কিন্তু অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। গবেষণাগারের জন্য ভবন নির্মাণ করা হলে গবেষণায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা সম্ভব। তবে যেহেতু এখনো এখানে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে ওঠেনি, সে জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন, শ্রেণিকক্ষ, পরিবহন–সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়নের বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। এসব প্রকল্প অনুমোদন পেলে দ্রুত সমস্যাগুলো সমাধান হবে।

আছে নানা অর্জনও

নানা সংকটের মধ্যেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কিছু সাফল্য আছে। ২০২০ সালে এক গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস মাহমুদ। তিনি ‘পিট ল্যাট্রিন’ বা আধাপাকা শৌচাগার থেকে ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর প্রবন্ধ আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (এসিএস) থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকা ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। গবেষণাকর্মটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একাডেমিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘নেচার’ পরিচালিত ‘নেচার ইনডেক্স ২০২০’-এ স্থান পায়। ৮২টি গবেষণাপত্রের মধ্যে ওই গবেষণাপত্র সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় অনুদান পেয়ে অ্যাডভান্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে অ্যাডভান্স ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজ আলম। একইভাবে ২০২১ সালে বায়ো মেমব্রেন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ‘বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছেন বরিশাল বিভাগের গবেষক দল। নেতৃত্বে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রক্টর খোরশেদ আলম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষার গুণগত মান, পরিবেশ উন্নয়ন ও গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত কর্মকৌশল প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতির কারণে সবকিছু স্থবির ছিল প্রায় দুই বছর। সেটার ধকল এখনো আছে। তারপরও বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’