৩৬ প্রার্থীর নামে ১৫৮ মামলা

১টি থেকে ২৫টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে একেকজনের বিরুদ্ধে। ২৭ শতাংশ কাউন্সিলর প্রার্থী মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি। 

খুলনা জেলার মানচিত্র

খুন, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদক ব্যবসা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, প্রতারণা, আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটানোসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এ রকম অপরাধে ৩৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে ১৫৮টি মামলা রয়েছে।

সর্বনিম্ন ১টি থেকে সর্বোচ্চ ২৫টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে একেকজনের বিরুদ্ধে। এই মামলাগুলোর বিচারকাজ চলমান। এর বাইরে ৩৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে আরও ৯০টি মামলা ছিল। মামলাগুলো থেকে তাঁরা বিভিন্ন সময় অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ১২ জুন খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হলফনামায় দেখা যায়, বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা বেশি। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে।

প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে দেখার বিষয় তাঁরা কেউ ওই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কি না। আর জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের নির্বাচন করার প্রবণতা কয়েক বছর ধরে অনেক বেড়েছে।
কুদরত ই খুদা, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাধারণ সম্পাদক

৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালের নামে আছে ২৫টি মামলা। ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জামায়াত নেতা এস এম আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জামায়াত নেতা মো. শফিকুল আলমের বিরুদ্ধে ১৩টি, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাশিউর রহমানের বিরুদ্ধে চারটি এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জামায়াত নেতা মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা রয়েছে। ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া শেখ মো. গাউসুল আজমের বিরুদ্ধে চারটি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া চলমান।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ১২টি, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শামসুল আলমের বিরুদ্ধে ১২টি, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী ফজলুল কবীরের বিরুদ্ধে ১৫টি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আশফাকুর রহমানের বিরুদ্ধে ২টি এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাহবুব কায়সারের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা আছে।

অন্তত ৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে মামলা নিয়ে কথা হয়। তাঁরা অভিন্ন সুরে বলেন, রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করার জন্য এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় বিভিন্ন সময়ে এসব মামলা হয়।

 ৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মামলাগুলো হয়েছে। মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশের করা।

 ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে হত্যাসহ দুটি মামলা বিচারাধীন। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর সুলতান মাহামুদের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলা, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী চিকিৎসক এ এস এম সায়েম মিয়া নারী নির্যাতন মামলার আসামি। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শামীম পারভেজ হত্যাসহ তিনটি মামলার আসামি। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর গোলাম মওলার নামে মামলা থাকলেও হলফনামায় তিনি মামলার ধারা উল্লেখ করেননি।

এবার খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ১৩৬ জন। সবার হলফনামা প্রথম আলোর কাছে আছে। তাঁদের মধ্যে ১০৬ জনের পেশাই ব্যবসা; অর্থাৎ প্রার্থীদের ৭৮ শতাংশই ব্যবসায়ী। এর মধ্যে ঠিকাদার আছেন ৩৩ জন। ঠিকাদারি থেকে শুরু করে, গৃহিণী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রাইভেট টিউটর, পরামর্শক, চাকরিজীবী, জমিজমা বিক্রিতে সহায়তাকারী, শ্রমিক পেশার মানুষও কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন।

প্রার্থীদের মধ্যে ১৬ জন স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি ২১ জন; অর্থাৎ প্রার্থীদের ২৭ শতাংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হননি। ২৪ জন প্রার্থী মাধ্যমিক পাস করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস রয়েছেন ৩১ জন। ২৮ জন স্নাতক ও ১১ জন স্নাতকোত্তর পাস প্রার্থী আছেন। অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। প্রার্থীদের মধ্যে ৪ জন প্রার্থী প্রকৌশল বিদ্যায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছেন। একজন প্রার্থী বিডিএস ডিগ্রিধারী।

সম্পদের দিক থেকে বেশ কয়েকজন কোটিপতি প্রার্থী আছেন। কোনো বার্ষিক আয় নেই, এমন প্রার্থীও আছেন। অন্তত ৪১ জন প্রার্থীর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। প্রার্থীদের দায়দেনার পরিমাণ ৩ লাখ থেকে ৪৩ কোটি টাকা পর্যন্ত।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাধারণ সম্পাদক কুদরত ই খুদা প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে দেখার বিষয় তাঁরা কেউ ওই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কি না। আর জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের নির্বাচন করার প্রবণতা কয়েক বছর ধরে অনেক বেড়েছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ের অপসংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ও সৃজনশীল পেশার মানুষ নির্বাচনে আসতে চান না। রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়াটা পরিতাপের বিষয়। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।