সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়া যেন আরেক কলসিন্দুর

খেলা শেষে গ্রামের পথে সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়ার মেয়েরা। গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের কথা দেশের কে না জানে। পাঠ্যবইয়েও স্থান পেয়েছে গ্রামটি। জাতীয় দলের খেলোয়াড় তহুরা খাতুন, মারিয়া মান্দা, সানজিদা খাতুনসহ অনেক কৃতী খেলোয়াড় উঠে এসেছেন এই গ্রাম থেকে। দারিদ্র্য জয় করে দেশসেরা ফুটবলার হয়ে ওঠা কলসিন্দুরের মেয়েদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের করেরহাটের সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়ার মেয়েদের অনেক মিল। পাহাড়ঘেরা সাইবেনীখিল যেন আরেক কলসিন্দুর।

মিরসরাই উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পাড়া সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়া। সবুজে ঘেরা এ পাড়ায় ৮২টি ত্রিপুরা পরিবারের বসবাস। পাহাড়ের লেবুবাগানগুলোতে দিনমজুরি করে চলে তাদের সংসার। এনজিওর ঋণের কিস্তি শোধ আর দুবেলা ভাত জোগাড় করার চিন্তায় দিন পার করেন এ পাড়ার মানুষেরা।
অথচ এ পাড়ারই ৯ মেয়ে খেলছে মিরসরাই উপজেলা বালিকা ফুটবল দলে। তাদের পায়ে ভর করেই দলটি এ বছর স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা সমিতি আয়োজিত ৫০তম জাতীয় গ্রীষ্মকালীন ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয়েছে। শুক্রবার বিভাগীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রাঙামাটি জেলার সঙ্গে পরাজিত হয় তারা। এই কিশোরী ফুটবলারদের সবাই উপজেলার করেরহাট কামিনী মজুমদার উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দুর্গম এলাকার অখ্যাত একটি পাড়ার কিশোরীদের এমন সাফল্যের জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর মিরসরাই উপজেলা মিলনায়তনে তাদের সংবর্ধনা দেবে উপজেলা প্রশাসন।

এ পাড়ারই দিনমজুর বিরেন্দ্র ত্রিপুরার মেয়ে বিজলী ত্রিপুরা। মিরসরাই উপজেলা বালিকা ফুটবল দলের প্রাণভোমরা সে। অথচ প্রতিভাবান এই ফুটবলারের বাড়িতে নেই থাকার ঘরটিও। পাড়ার এক প্রতিবেশীর ঘরে থেকে চলছে তার লেখাপড়া আর খেলাধুলা। প্রতিদিন দুই কিলোমিটার হেঁটে, আরও চার কিলোমিটার বাসে পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যায় সে। বিজলীর মতো দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেই ফুটবল খেলছে এ পাড়ারই আরও ৯ কিশোরী।

দলের মূল একাদশের ১০ জন খেলোয়াড়ই ত্রিপুরা কিশোরী। এই মেয়েদের পরিবার এতই হতদরিদ্র যে মেয়েগুলোকে খেলার জামা-জুতা দূরে থাক, ঠিকমতো খাবারও দিতে পারে না।

বিজলী ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলে, ‘ফুটবল খেলতে আমার খুব ভালো লাগে। চার মাস আগে ঝড়ে আমাদের ঘরের চালা উড়ে যাওয়ার পর ভারী বৃষ্টিতে মাটির দেয়াল ধসে পড়ে ঘর বিলীন হয়ে গেছে। সেই থেকে আমি ও আমার বড় বোন পাড়ার এক প্রতিবেশীর ঘরে থাকি। অন্যের ঘরে থেকে আমার পড়াশোনা ও খেলা চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।’

মিরসরাই উপজেলা দলটির খেলোয়াড়েরা হচ্ছে মমতা ত্রিপুরা (অধিনায়ক ও গোলরক্ষক), চন্দ্রিমা দাশ, মোহনা ত্রিপুরা, বিজলী ত্রিপুরা, মিতালী ত্রিপুরা, শীতলী ত্রিপুরা, রূপা ত্রিপুরা, মৌমিতা ত্রিপুরা, অর্চনা ত্রিপুরা, অশ্বা ত্রিপুরা ও বর্ষা ত্রিপুরা। তাদের মধ্যে চন্দ্রিমা দাশ, শীতলী ত্রিপুরা ও রূপা ত্রিপুরা ছাড়া মূল দলের আটজনই সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়ার খেলোয়াড়।

মিরসরাই উপজেলা পরিষদ কার্যালয় ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা সমিতি আয়োজিত ৫০তম জাতীয় গ্রীষ্মকালীন ফুটবল প্রতিযোগিতায় মিরসরাই উপজেলায় বালিকা দল আহ্বান করেও করেরহাট কামিনী মজুমদার উচ্চবিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো দল পাওয়া যায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এ বিদ্যালয়ের মেয়ে দলকে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে জেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়।
জেলা পর্যায়ের প্রথম ম্যাচে সীতাকুণ্ড উপজেলাকে হারায় মিরসরাই উপজেলা দলের মেয়েরা। সেমিফাইনালে রাউজান উপজেলাকে হারিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ফাইনালে পাহাড়তলী স্কুল অ্যান্ড কলেজকে হারিয়ে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয় মিরসারাই উপজেলা। জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিল দলটির মধ্যমাঠের খেলোয়াড় চন্দিমা দাশ।

দুর্গম এলাকার অখ্যাত একটি পাড়ার কিশোরীদের এমন সাফল্যের খুশি সবাই। গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে
ছবি: প্রথম আলো

এরপর অঞ্চল (বিভাগ) পর্যায়ের প্রথম ম্যাচে নোয়াখালী জেলা ও সেমিফাইনালে বান্দরবানকে হারিয়ে বিভাগীয় ফাইনালে উঠে মিরসরাই উপজেলা বালিকা দল। শুক্রবার চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ফাইনাল খেলায় রাঙামাটি জেলার সঙ্গে হেরে বিভাগে রানার্সআপ হয় মমতা, বিজলী ত্রিপুরা ও চন্দ্রিমা দাশের দল।

সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়ার ঊষা ত্রিপুরা লেবুবাগান করার পাশাপাশি পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার তদারক করেন। মূলত তাঁর উৎসাহে ফুটবল খেলা শুরু করে পাড়ার মেয়েরা। মিরসরাই উপজেলা বালিকা দলে এ পাড়ারই ৯ ত্রিপুরা কিশোরীর অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দলে আমাদের পাড়ার ৯ জন ছাড়াও পাশের নলখো ত্রিপুরাপাড়ারও দুই কিশোরী আছে। দলের মূল একাদশের ১০ জন খেলোয়াড়ই ত্রিপুরা কিশোরী। এই মেয়েদের পরিবার এতই হতদরিদ্র যে মেয়েগুলোকে খেলার জামা-জুতা দূরে থাক, ঠিকমতো খাবারও দিতে পারে না। প্রতিভা দেখে আমার নিজের খরচে তাদের মধ্যে বিজলী, মমতা ও অর্চনা ত্রিপুরাকে গত বছর ছয় মাসের একটি ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পাঠিয়েছিলাম। পরে ওরা ফিরে পাড়ার অন্য মেয়েদের ফুটবল শিখিয়েছে। ওরাই এখন মিরসরাই উপজেলা দলের হয়ে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে মাঠ মাতাচ্ছে। অতিদরিদ্র পরিবারের এই মেয়েরা প্রশিক্ষণ পেলে জাতীয় সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।’

এই বালিকা দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় মৌমিতা ত্রিপুরা। তার মা সুসনা ত্রিপুরা লেবুবাগানে দিনমজুরি করে সংসার চালান। ফুটবল খেলায় মেয়ের এমন সাফল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে চোখ ছলছল করে উঠে এই নারীর। প্রশ্ন করেন, ‘মেয়ে কী করে ভালো খেলে। ওকে তো ঠিকমতো খেতেও দিতে পারি না। সকালে শাক বা সবজি মাখিয়ে একটু ভাত খেয়ে যায় স্কুলে। ফেরে সেই সন্ধ্যায়। কত দিন দুপুরে কিছু খেতে পায় না। খেলতেও শরীরে শক্তি লাগে। ওকে যে ভালো কিছু খাওয়াব, সে সাধ্য আমার নাই।’

জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একের পর এক সাফল্য ছিনিয়ে আনা মেয়েদের এ দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন করেরহাট কামিনী মজুমদার উচ্চবিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক পলাশ চন্দ্র মল্লিক। তিনি বলেন, ‘এ টুর্নামেন্ট সামনে রেখে গত তিন মাস মেয়েদের নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বিদ্যালয় থেকে খেলার পোশাক আর জুতা দেওয়া হয়েছে। দলটির মূল একাদশের ১০ জনই ত্রিপুরা কিশোরী। ওদের মধ্যে আবার ৮ জন একই পাড়ার। অতিদরিদ্র পরিবারের মেয়ে সবাই। ওরাই দলটাকে এত দূর টেনে নিয়েছে। গোলকিপার ও অধিনায়ক মমতা ত্রিপুরা প্রতিটি খেলায় আলাদা করে সবার নজর কেড়েছে। সুযোগ করে দিতে পারলে জাতীয় পর্যায়ে খেলার মতো প্রতিভা আছে এ দলে।’

বালিকা দলটির এমন সাফল্যের বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বালিকা দল জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দারুণ খেলেছে। বিশেষ করে দলের ত্রিপুরা কিশোরী খেলোয়াড়েরা আলাদা করে নজর কেড়েছে সবার। এমন সাফল্য বয়ে আনায় মঙ্গলবার তাদের সংবর্ধনা দেব আমরা।’