পাড়াগাঁয়ে আলো ছড়ানো এক বিদ্যাপীঠ

শুধু পড়াশোনা না, নিয়ম–শৃঙ্খলাতেও অনন্য জয়পুরহাটের কালাইয়ের ওমর কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড ওমর গার্টেন একাডেমিছবি: সোয়েল রানা

বলতে গেলে পাড়াগাঁয়ের একটি বিদ্যালয়। ফলাফল ঈর্ষণীয়। শতভাগ পাস তো আছেই, প্রতিবছর ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পায়। এ কারণে জেলার সেরা বিদ্যালয়ের খেতাব জুটেছে বহু আগেই। পড়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়টিতে রয়েছে ভাষা ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, গণিত ক্লাব, কম্পিউটার ক্লাব, আছে খেলাধুলার নানা ক্লাব। পড়াশোনার বাইরে এখানকার শিশুরা বই পড়ে, সাধারণ জ্ঞানের চর্চা ও সৃজনশীল নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আট শতাধিক শিক্ষার্থীর বেসরকারি বিদ্যালয়টিতে আবাসিক ব্যবস্থাও আছে। আশপাশের জেলা থেকে পড়তে আসে অনেকে।

এটি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা শহরের একটি বিদ্যালয়। নাম ওমর কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড ওমর গার্টেন একাডেমি। এখানকার নিয়মশৃঙ্খলা ও পাঠদান পদ্ধতি আর দশটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। বিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের প্রথম ছয় মাসে সিলেবাস শেষ করা হয়। পরের ছয় মাস মডেল টেস্ট ও অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে শিক্ষার্থীরা।

এই বিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ একটু আলাদা বলে মন্তব্য করলেন অভিভাবক মনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানে খুবই শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলে। পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার ওপরও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব। এখানকার শিক্ষার্থীরা শুধু মেধাবী নয়, পরবর্তী জীবনে নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষানুরাগী আবদুর রশীদ তালুকদার
ছবি: প্রথম আলো

বাবার স্বপ্ন, ছেলের পথচলা

২৮ শিক্ষার্থী ও দুজন শিক্ষক নিয়ে ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু হয় ‘ওমর কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড ওমর গার্টেন একাডেমি’র। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষানুরাগী আবদুর রশীদ তালুকদার। তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর গড়া বিদ্যাপীঠ আলো ছড়াচ্ছে উত্তরের জনপদে।

আবদুর রশীদ তালুকদারের বাড়ি উপজেলা শহরের তালুকদার পাড়ায়। তিনি ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক এবং ১৯৭৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর ব্যবসা করে ধীরে ধীরে সাফল্য পান।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রতিষ্ঠার পর আবদুর রশীদ তালুকদার নিজেই প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যালয়েই ব্যয় করতেন আবদুর রশীদ। শুরুতেই গুরুত্ব দেন শৃঙ্খলা ও পড়াশোনার দিকে। সাফল্যও আসে। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফল করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবদুর রশীদ তালুকদার মারা গেলে তাঁর বড় ছেলে ওমর আবদুল আজিজ তালুকদার প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালাইসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে এই বিদ্যালয়। বাবার স্বপ্ন ছিল এ প্রতিষ্ঠানকে দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা। সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি।’

সাফল্যের পর সাফল্য

প্রথমবারের মতো ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ১৪ বছর ধরে এসএসসিতে সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পেয়ে জেলায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে এ বিদ্যালয়।

জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফলেও জেলায় শীর্ষস্থানে থেকেছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এসব পরীক্ষায় সব সময় পাসের হারও থাকে শতভাগ।
সর্বশেষ ২০২২ সালে এই বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে ১৭৪ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পায় ১৬৭ জন। ২০২১ সালে ১০৮ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবাই পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৫ জন। ২০২০ সালে ৯৬ জনের মধ্যে শতভাগ পাস, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ জন পরীক্ষার্থী।

নিয়ম–শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে ওমর কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড ওমর গার্টেন একাডেমির শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

ছয় মাসেই সিলেবাস শেষ

জয়পুরহাট ছাড়াও বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলার শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তাদের থাকার জন্য এখানে রয়েছে ছাত্রাবাস। তিনতলা ছাত্রাবাসটিতে শ খানেক শিক্ষার্থী থাকে।

বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট শতাধিক। শিক্ষক ৭৪ জন। প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেতন ৪০০ থেকে ৮৫০ টাকা। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেতন ছাড়াই পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ জন্য রয়েছে একটি তহবিল। চালু আছে শিক্ষাবৃত্তিও।

ওমর গার্টেন একাডেমি থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে শিক্ষার্থী সামিউল হক। সে প্রথম আলোকে বলে, ‘বিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের প্রথম ছয় মাসে সিলেবাস শেষ করানো হয়। পরবর্তী ছয় মাস মডেল টেস্ট ও অনুশীলনে ব্যস্ত রাখা হয়। প্রতিদিন নিয়ম করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অভ্যাস গড়ে তোলা হয়। পড়াশোনার বাইরের সময়টুকু বই পড়া, সাধারণজ্ঞান চর্চা এবং সৃজনশীল নানা প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকি আমরা।’

পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা অনন্য
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন যেমন

২০০৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম ব্যাচে প্রতিষ্ঠানটির শতভাগ পাস ছাড়াও সব পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। এরপর বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। শিক্ষার্থী বাড়ার পর জোর দেওয়া হয় অবকাঠামো উন্নয়নে। গড়ে তোলা হয় কম্পিউটার ল্যাব, গ্রন্থাগার আধুনিকায়ন, খেলার মাঠ সম্প্রসারণ ও মিলনায়তন।

কালাই উপজেলা পরিষদের ফটকের উল্টো দিকে বগুড়া-জয়পুরহাট সড়ক থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে বিদ্যালয়টির অবস্থান। বিদ্যালয়ের আয়তন প্রায় চার বিঘা। ইউ আকৃতির বিদ্যালয় ভবনের একটির অবস্থান মাঠের উত্তর দিকে। চারতলাবিশিষ্ট এই ভবন শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ও অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিম পাশে তিনতলাবিশিষ্ট আরেকটি ভবন শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উত্তর দিকে আছে আরেকটি ভবন। এখানে পাঠাগার ছাড়াও রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব ও বিজ্ঞানাগার। আর মাঠের পূর্ব দিকে আছে  মুক্তমঞ্চ।

বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক একটি সূত্র জানায়, আবাসিক শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখতে আছেন ৯ শিক্ষক। রয়েছে ভাষা ক্লাব, বিজ্ঞান ও গণিত ক্লাব, কম্পিউটার ক্লাব ও বিভিন্ন খেলাধুলার ক্লাব। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় সাফল্য পাচ্ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ওমর গার্টেন একাডেমি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বর্তমানে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই বিদ্যালয়ের পাঠদানপদ্ধতি আলাদা। এখানে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদেরও অনেক পড়াশোনা করতে হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত হওয়ায় তাঁরা নিজেদের মতো করে দেখভাল করতে পারেন। পড়ালেখার ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।