‘কোম্পানি সব দেয়, শুধু হামরা তামাক নাগাই’ 

স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কম পুঁজি ব্যবহার করে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা।

রংপুরে খেতজুড়ে কেবল তামাক আর তামাক। সম্প্রতি তারাগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলায় তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বীজ ও সারের টাকা আগাম সরবরাহ করায় দিন দিন বেড়েই চলেছে তামাকের চাষ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কম পুঁজি ব্যবহার করে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। তামাক চাষের নির্দিষ্ট কোনো রাসায়নিক সার বরাদ্দ না থাকলেও ব্যাপক পরিমাণ সার ব্যবহার করা হচ্ছে। 

বদরগঞ্জের মোস্তফাপুর মাঠে কথা হলে ওই গ্রামের কৃষক সেকেন্দার আলী বলেন, ‘তামাক চাষে কোনো লোকসান নাই। দ্বিগুন লাভ। কোম্পানির লোক আগোতে বীজ দেয়, সার, ওষুধের টাকা দেয়। ভুঁইয়োত দাঁড়ে থাকি কোম্পানির লোক আবাদ তুলি দেয়। হামরা খালি তামাক নাগাই আর কাটি।’

কয়েকজন কৃষক বলেন, ওই দুই উপজেলায় প্রায় দুই যুগ ধরে তামাক চাষ হচ্ছে। মাঝে কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন এনজিওর তামাকবিরোধী প্রচারনায় এলাকায় তামাক চাষ অনেক কমে আসে। কিন্তু গত ২ বছর থেকে আলু ও সবজিসহ অন্য ফসলের দাম কম থাকায় এবং তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তামাক চাষের জন্য বিনা মূল্যে কৃষকদের বীজ সরবরাহ, সার ও কীটনাশক কিনতে ঋণ প্রদান করায় কৃষকেরা আবারও ক্ষতিকর তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এতে ওই দুই উপজেলায় তামাক চাষ বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর ২৪০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ বেশি হয়েছে। বোরো চাষের জন্য বরাদ্দ করা রাসায়নিক সার এসব তামাক খেতে দেওয়া হচ্ছে।

 কৃষি বিভাগ জানায়, নভেম্বরের শেষে আলু, তামাক ও জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বোরো চাষ শুরু হয়। এ বছর ৫৩৫০ হেক্টরে আলু ও ২৪১১৯ হেক্টর বোরোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

দুই উপজেলায় রাসায়নিক সারের ২২ জন ডিলার আছে। গত তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এসব ডিলারকে আলু ও বোরো চাষের জন্য ২ হাজার ১৯৮ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮০ মেট্রিক টন সার বিক্রি হয়ে গেছে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিক্রি হওয়া সারের ২০ ভাগ তামাক খেতে চলে গেছে। বাকি ৮০ ভাগ সার আলু ও বোরো খেতের জন্য নেওয়া হয়েছে।

কৃষি বিভাগ, কৃষক ও তামাক কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ওই দুই উপজেলায় নভেম্বরের শেষ থেকে তামাক চাষ শুরু হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর তামাক চাষ বেড়েছে। দুই উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গত বছরে চাষ হয়েছিল ৮৫০ হেক্টরে।

তারাগঞ্জের ইকরচালী, হারিয়ারকুঠি, সয়ার, কুর্শা, আলমপুর ও বদরগঞ্জের কালুপাড়া, দামোদরপুর, রামনাথপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে তামাক আর তামাক।

তারাগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘ তাংকুর চাষের ঋণও পাওয়া যায়। ওই জন্যে তাংকু নাগাছি। তাংকু চাষে লস নাই, লাভ বেশি।’

মানব কল্যাণ ঘর সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী জেবা নাসরিন বলেন, তামাক চাষে প্রচুর সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করায় মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। এতে মাছ, জলজ উদ্ভিদের ক্ষতি হয়। 

তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নীল রতন দেব জানান, তামাকের উপাদান বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, আর শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে এগুলো কৃষকের শরীরে প্রবেশ করে। তাই যেসব কৃষক তামাক চাষের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের হৃদ্‌রোগ ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসসুম বলেন, তামাক চাষে চাষিদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু লাভ বেশি পাওয়ায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।