স্বর্ণার বিকল্প পেলেন রাজশাহীর চাষিরা, নতুন এই ধানের ফলন বেশি, রোগবালাইও কম
মাঠে সব স্বর্ণা ধানের গাছ শুয়ে পড়েছে। পাশেই ব্রি-১০৩ ধান দিব্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ধানের গাছও স্বর্ণার চেয়ে লম্বা। কাণ্ড শক্ত তাই বাতাসে হেলে পড়েনি। পেকেছে স্বর্ণার চেয়ে প্রায় ১৫ দিন আগে। ফলনও বেশি। আবার স্বর্ণার চেয়ে রোগবালাই কম। চাল তুলনামূলক চিকন হওয়ায় চাষিরা দামও পাবেন বেশি।
এই প্রথম রাজশাহীর আটজন চাষি ২৪ বিঘা জমিতে এই নতুন ধান চাষ করেছেন। সোমবার (১০ নভেম্বর) বিকেলে জেলার তানোরের কুজি শহর মাঠে এর শস্য কাটা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞানীসহ স্থানীয় ১০০ চাষি উপস্থিত ছিলেন। আমন মৌসুমে রাজশাহীর চাষিদের ব্রি-১০৩ ধান চাষ করা যেতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন কর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণা ধান আমন মৌসুমে রাজশাহীর চাষিদের কাছে দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয় ছিল। এ বছরও রাজশাহীতে এই ধান চাষ হয়েছে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে। গত পাঁচ বছর আগে ছিল ২৮ হাজার হেক্টর।
সোমবার বিকেলে তানোরের কুজি শহর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় মোন্থার প্রভাবে গত ৩১ অক্টোবর রাতে যে বৃষ্টি ও বাতাস হয়েছে, তাতেই মাঠের স্বর্ণা ধান শুয়ে পড়েছে। কিন্তু পাশেই আটজন চাষির ব্রি-১০৩ ধান দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন বললেন, স্বর্ণা ধান রাজশাহীতে বহুকাল ধরে চাষিরা আবাদ করে আসছেন। ব্রি-১০৩ ধান এই প্রথমবারের মতো রাজশাহীতে আটজন চাষি চাষ করেছেন। তিনি বলেন, স্বর্ণা ধান ১৯ মণ পর্যন্ত ফলন দেয়। আর তাদের উদ্ভাবিত দেশি জাতের এই ধানের ফলন গড়ে ২২ মণ পর্যন্ত হবে। রোগবালাই কম। দাম বেশি পাওয়া যাবে। চাষিরা লাভবান হবেন। সহজে এই ধান শুয়ে পড়ে না। এ জন্য চাষিরা এই ধানের খড়ও বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাপস কুমার হোড়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুমনা হক, তানোরের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা সুভাষ কুমার মণ্ডল ও স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানীয় নূর মোহাম্মদ।
বিজ্ঞানীরা জানান, ব্রি-১০৩ জাতটি উচ্চফলনশীল, গড় উচ্চতা ১২৫ সেন্টিমিটার, জীবনকাল ১২৮ থেকে ১৩০ দিন। এই ধানের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ দশমিক ২ মেট্রিক টন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ৮ টন পর্যন্ত ফলন হয়। দানা লম্বা, চিকন এবং ভাত ঝরঝরে ও সুস্বাদু। পাতা খাড়া এবং পাকার সময় কাণ্ড ও পাতার রং সবুজ থাকে। চালের আকার আকৃতি লম্বা ও চিকন হওয়ার কৃষক ধানের দাম বেশি পাবেন।
স্বর্ণার বিকল্প জাত হিসেবে এই জাতটি চাষ করা যেতে পারে। স্বর্ণা ধানের গড় জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। স্বর্ণার চেয়ে প্রায় ১৫ দিন আগে এই ধানে পাকে। কাণ্ড শক্ত হওয়ায় গাছ হেলে পড়ে না। এ জন্য কৃষক খড়ের দামও বেশি পাবেন। এই জাতটি রোপা আমন মৌসুমে বৃষ্টিনির্ভর জাত হিসেবেও চাষের উপযোগী। এর রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণও কম।
রাজশাহীর স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ ব্রি-১০৩ ধান এবার তিন বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। তাঁর জমিতেই প্রথমে শস্য কাটা হয়। তিনি বিঘায় ২১ দশমিক ৯৩ মণ পেয়েছেন। নূর মোহাম্মদ ছাড়াও এবার এই ধান চাষ করেছেন মোশাররফ হোসেন, টিপু সুলতান, জসীম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ, আবদুল মজিদ ও কিতাবুর রহমান।
শস্য কাটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হিরানন্দপুর গ্রামের চাষি মাইনুল ইসলাম। তিনি বললেন, তাঁরা এত দিন আমন মৌসুমে স্বর্ণা ধান চাষ করেছেন। ফলন পেয়েছেন বিঘায় সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ১৯ হারে। এই ধানের ফলন দেখলাম প্রায় ২২ মণ। তিনি বলেন, এখন থেকে এই ধানের বীজ পেলে আর স্বর্ণা ধান করতে হবে না।
আরেক চাষি মোশাররফ হোসেন বলেন, তানোরের মাঠ আলুর জন্য ভালো। এই ধান স্বর্ণার চেয়ে ১৫ দিন আগেই উঠছে। আলু চাষের জন্যও ভালো হবে। এবার থেকে তিনি এই ধানই চাষ করবেন।