পটিয়ার সাড়ে ১১ কোটি টাকার কিচেন মার্কেট যে কারণে পাঁচ বছরেও চালু হলো না
চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভায় এক ভবনে স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক কাঁচাবাজার, ব্যাংক-বিমা অফিস ও বিপণিকেন্দ্র চালুর লক্ষ্য নিয়ে মাল্টিপারপাস কিচেন মার্কেট উদ্বোধন হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তৈরি চারতলা ভবনের ৬৩টি দোকানও বরাদ্দ দিয়েছিল পৌরসভা। তবে পাঁচ বছরেও চালু হয়নি এ মার্কেট। দোকান বরাদ্দ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের কেউই পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্কেটের নিচতলায় কাঁচাবাজার বসাননি। চালু হয়নি বরাদ্দ নেওয়া অন্য দোকান-প্রতিষ্ঠানও। ব্যবহৃত না হওয়ায় ভবনের কক্ষগুলো বেহাল হয়ে পড়েছে। পৌরসভাও বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
পটিয়া পৌরসভার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১১ কোটি ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৩৮ টাকা ব্যয়ে কিচেন মার্কেটের চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয় ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর। পৌরসভার মালিকানাধীন ভবনটি নির্মাণে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। পৌরসভার বীরকন্যা প্রীতিলতা সড়কে ৩৫ শতাংশ জায়গার ওপর ভবনের উদ্বোধন হয় ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর। এর আগে ২০১৯ সালে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ভবনের ৬৩টি দোকানও বরাদ্দ দেওয়া হয়।
যাঁরা বরাদ্দ পেলেন
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পৌরসভার মালিকানাধীন কিচেন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের কেউই কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী নন। ৬৩টি দোকান বরাদ্দ নেওয়া ৪৮ ব্যবসায়ীর মধ্যে প্রবাসী রয়েছেন ১৪ জন। এ ছাড়া আছেন চাকরিজীবী, ব্যাংকার, প্রবাসীর স্ত্রী, গৃহিণী, ঠিকাদার, ইটভাটার মালিক, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, বড় দোকানি, চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা, সার্ভেয়ার, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন। এই মালিকেরা ১০–২০ লাখ টাকা সালামি দিয়ে পৌরসভা থেকে দোকান বরাদ্দ নেন। দোকান ভাড়া থেকে আয় হবে, এমন ভাবনা থেকেই বরাদ্দ নিয়েছিলেন বলে দোকানমালিকেরা জানিয়েছেন।
পৌর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলাকার ইটভাটার মালিক মো. মুছা সাতটি, ব্যবসায়ী প্রদীপ বিশ্বাস পাঁচটি, ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম তিনটি, প্রবাসী মো. হাসান চারটি ও পটিয়া সদরের ব্যবসায়ী নুরুল হাসান নিয়েছে দুইটি করে দোকান। বরাদ্দ পাওয়া দোকানমালিকদের বক্তব্য, পৌরসভা দোকান চালুর জন্য যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল, তা দেয়নি। এ ছাড়া কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের এনে কিচেন মার্কেটের নিচতলার বাজার চালুর আশ্বাস দিলে সেটিও করেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। বাজার না বসায় ভাড়াও পাচ্ছেন না দোকানে বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাঁদের টাকাও উঠে আসছে না।
তবে পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে কোনো দায় নিতে রাজি নন। জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘কিচেন মার্কেট প্রকল্পে কাদের দোকান বরাদ্দ দিতে হবে, এমন কোনো প্রস্তাব ছিল না। পৌরসভার নিজস্ব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সালামি ও নির্ধারিত ভাড়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দরপত্রের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দিয়েছে। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরাই নিয়েছেন বরাদ্দ। কে কোনো পেশার, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’
সরেজমিন চিত্র
সম্প্রতি কিচেন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, নিচতলায় কাঁচাবাজারের জন্য তিন পাশে দেয়াল দেওয়া ৬৩টি দোকানের শেড তৈরি করা হয়েছে। চুক্তি অনুয়ায়ী সবজি, মাছ, মাংস, মুরগি, মুদি, শুঁটকি, ফল, ডিম, পান-সুপারি ইত্যাদি প্রতিটি দোকানের ধরন অনুয়ায়ী নাম লিখে ফলক টানানো হয়েছে। তবে সেসব দোকানে এখন বস্তা ও মালামাল রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় তলায় একটি ব্যাংকের কার্যালয় ও একটি সিগারেটের দোকান ছাড়া আর কোনো দোকানই চালু হয়নি। তৃতীয় তলায়ও মুঠোফোন ব্যাংকিংয়ের একটি দোকান চালু হয়েছে। বাকিগুলো খালি পড়ে আছে। চতুর্থ তলাও কোনো দোকান, অফিস চালু হয়নি। মার্কেটের সামনে পার্কিং লটে দাঁড়ানো মোটরসাইকেল ও রিকশা থেকে রসিদ দিয়ে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
যা বলছেন দোকানমালিকেরা
কিচেন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি শহীদুল ইসলাম নিচতলায় ৩৯ লাখ টাকায় তিনটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, দোকান বরাদ্দের সময় পৌর মেয়র তাঁদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, লিফট, ব্যাংকের এটিএম বুথ থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোনোটিই করা হয়নি। তাই তাঁরা দোকান চালু করতে পারছে না।
শহীদুল আরও বলেন, এখানে প্রতিটি দোকান ১০–২০ লাখ টাকা সালামি দিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কোনো টাকা তুলতে পারেননি। বর্তমানে ভবনের পার্কিং থেকে টাকা তুলছে পৌরসভা। অন্যদিকে খালি দোকানে মালামাল রাখা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। এতে পুরো মার্কেটটি গুদামে পরিণত হয়েছে।
দোকান বরাদ্দ নেওয়ার সময় তৎকালীন পৌর মেয়র ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, থানার হাটের কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের এখানে বসানোর ব্যবস্থা করবেন। তাঁদের কাছ থেকে বরাদ্দপ্রাপ্ত দোকানমালিকেরা ভাড়া পাবেন। এ ধরনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন। কিন্তু পরবতী সময়ে তা করা হয়নি বলে দাবি করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল হাসান। তিনি বলেন, দোকান চালু করতে না পারায় তাঁরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
থানার হাটের যেখানে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে আগে দোকান ছিল ব্যবসায়ী মোজ্জাম্মেল হকের। নতুন কিচেন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন তিনিও। কিন্তু তিনি বরাদ্দ নেননি। দোকানও চালু করেননি। জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার দোকান ছিল নিচতলায়। তাই মার্কেটে দোকান বরাদ্দ চেয়েছিলাম নিচতলায়। কিন্তু সেখানে কাঁচাবাজার বরাদ্দ দেওয়া হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ আমাকে বরাদ্দ দিচ্ছেন দ্বিতীয় তলায়। তা ছাড়া সালামির টাকাও অনেক বেশি। তাই বরাদ্দ নিইনি।’ মোজাম্মেলের মতো ওই মার্কেটের পুরোনো দোকানিরা কেউই দোকান বরাদ্দ নেননি।
পটিয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নেজামুল হক বলেন, নিচের তলায় মূলত দোকান করার কথা হকার বা কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের। তবে কাঁচাবাজারের কেউ বরাদ্দ নেননি। তাই কাঁচাবাজার চালু করা যাচ্ছে না।
সাবেক মেয়র থানার হাটের কাঁচাবাজারের দোকানদারদের কিচেন মার্কেটে বসানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন কি না, জানাতে চাইলে নেজামুল হক বলেন, চুক্তিতে এ ধরনের কিছু নেই। মার্কেট চালু হলে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন, সিসিটিভি ক্যামেরা, লিফট ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা হবে। তিনি আরও বলেন, পাঁচ বছর আগে দোকান বরাদ্দ নিলেও ব্যবসায়ীরা এখনো কোনো ভাড়া পর্যন্ত দিচ্ছেন না। তারপরও পৌরসভা মার্কেটটি জমানোর চেষ্টা করছে।