ভোর হলেই শোনা যায় কয়েক শ কবুতরের ডাক

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার মহিরাণ গ্রামে নিজের কবুতরের খামারে রাজু রায়। সম্প্রতি তোলাছবি : প্রথম আলো

শখের বশেই বন্ধুদের কাছ থেকে সাত জোড়া কবুতর সংগ্রহ করেছিলেন রাজু রায় (৩৯)। সেই থেকেই কবুতর পালন শুরু। আর এখন ভোর হলেই রাজুদের বাড়িজুড়ে শোনা যায় কয়েক শ কবুতরের ডাক। দিনভর দেখা মেলে কবুতরের আকাশে ওড়ার অভূতপূর্ব দৃশ্য। নানা রঙের কবুতরের আকাশে ওড়ার দৃশ্যে শুধু মনই ভরে না, এই কবুতর হয়ে উঠেছে আয়েরও উৎস।

রাজু যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার মহিরাণ গ্রামের বিধান রায়ের ছেলে। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন তিনি। পরে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। মা–বাবার একমাত্র সন্তান রাজু। কবুতর পালন করে তাঁর শখ পূরণের পাশাপাশি এখন মাসিক আয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

মহিরাণ গ্রামে রাজু রায়ের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ঠিক সামনে তাঁর একটি তিনতলা ভবন। ভবনের নিচ ও দোতলায় কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ভবনের ছাদে ইটের গাঁথুনি এবং ভেতরে ও বাইরে তারের জালঘেরা দুটি টিনের ঘর। ছাদের ওপর তিনটি লোহার তারের খাঁচা। চিলেকোঠার ছাদের ওপর কাঠ, পলিথিন ও লোহার তারের জালঘেরা আরও একটি টিনের ঘর। ঘরের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। জায়গাটি উঁচু করে লোহার তার দিয়ে ঘেরা। ঘর ও খাঁচায় বিভিন্ন জাতের অনেকগুলো কবুতর। ভবনে ঢোকার পথে একটি ইলেকট্রনিকসের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দিয়েছেন রাজু। এই কবুতর ও ব্যবসাকে ঘিরেই কাটছে তাঁর জীবন।

রাজু প্রথম আলোকে বলেন, ‘কবুতর পোষার শখ ছিল। শখের বশে কবুতর পালন শুরু করি। শুধু আনন্দের জন্য কবুতর পালন করছি, এটা আমার আয়ের বড় উৎস নয়। মাঝেমধ্যে কবুতর বিক্রি করি। এই আয় থেকে ভালোভাবে কবুতর লালন–পালন করতে পারি।’

রাজু রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্নাতক পাস করার পর একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। তিন বছর চাকরি করার পর ২০১৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর নিজের তিনতলা ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে ইলেকট্রনিকসের ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় কবুতর পালনের সুযোগ তাঁর সামনে আসে। তিনি তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৯০০ বর্গফুটের ছাদে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে ইটের গাঁথুনি এবং ভেতরে ও বাইরে তারের জাল দিয়ে ঘিরে দুটি টিনের ঘর তৈরি করেন। চিলেকোঠার ছাদের ওপর কাঠ, পলিথিন ও লোহার তারের জালঘেরা আরও একটি টিনের ঘর নির্মাণ করেন। কবুতর ওড়ানোর জন্য ঘরের সামনে ফাঁকা জায়গায় উঁচু করে লোহার তার দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করেন।

রাজু যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার মহিরাণ গ্রামের বিধান রায়ের ছেলে। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন তিনি। কবুতর পালন করে তাঁর শখ পূরণের পাশাপাশি এখন মাসিক আয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

শখের বশে ২০১৮ সালে বন্ধুদের কাছ থেকে সাত জোড়া কবুতর সংগ্রহ করেন রাজু। শুরু করেন কবুতর লালন–পালন। ২০২০ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় নারায়ণগঞ্জের আতিফ সিকদারের। আতিফ সিকদার পার্টি নামে তাঁর একটি কবুতরের পার্টি রয়েছে। এই পার্টির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১৯। আতিফ সিকদার তাঁকে ২০ জোড়া কবুতর দেন। এরপর ধৈর্য ধরে ব্যবসা ও কবুতর লালন–পালন করতে থাকেন। একদিন কবুতর ডিম দিল, ডিম ফুটে বাচ্চা হলো। বাড়তে থাকল কবুতরের সংখ্যা। বাড়ল কবুতর সম্পর্কে জানার আগ্রহ। আকাশে ওড়ানোর কবুতরসহ নানা জাতের দামি কবুতরের খোঁজ পেলেন। পরে সেগুলো এনে পালন করা শুরু করলেন।

রাজু রায় বলেন, একটি ঘরের দুটি কক্ষ। একটি কক্ষে মেয়ে কবুতর ও অন্য কক্ষে ছেলে কবুতর রাখা হয়। অপর কক্ষটি ব্রিডার কক্ষ। বাচ্চা নেওয়ার দরকার হলে এই কক্ষে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে কবুতর রেখে জোড়া দেওয়া হয়। এ ঘরে ৮ থেকে ১০ দিনে মেয়ে কবুতর ডিম পাড়ে। ১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ৪৫ দিনে বাচ্চা উড়তে সক্ষম হয়। ছয় মাসে একটি কবুতর পূর্ণবয়স্ক হয়। তখন ছেলে কবুতর ও মেয়ে কবুতর চেনা যায়। বছরে ৮০টি বাচ্চা ফোটানো হয়। চিলেকোঠার ছাদের ঘরে ওড়ানোর জন্য ৮০টি কবুতর রাখা হয়। এদের ‘হাই ফ্লায়ার’ কবুতর বলে। এদের প্রায় এক মাস ধরে প্রস্তুত করা হয়। এই কবুতরের পায়ে ট্যাগ লাগানো হয়। সেখানে কবুতরের সিরিয়াল নম্বর ও মুঠোফোন নম্বর লেখা থাকে। ওড়ানোর সময় হারিয়ে গেলে কবুতরের পায়ে লাগানো ট্যাগে মুঠোফোন নম্বর দেখে ফোন করে অনেকে কবুতর ফিরিয়ে দেন। রাজুর এ পর্যন্ত ২৫টি কবুতর হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি কবুতর তিনি ফিরে পেয়েছেন।

রাজু রায় বলেন, প্রতিবছর গড়ে আটটি ‘হাই ফ্লায়ার পিজন টুর্নামেন্ট’ হয়। টুর্নামেন্টের পর কবুতরের দাম বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত তিনি ৪০টি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। ১৬টি টুর্নামেন্টে পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর দুই মাসের একটি কবুতরের বাচ্চা সর্বোচ্চ একটানা ১০ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট আকাশে উড়েছে।

রাজু রায়ের খামারে বর্তমানে ১৬টি জাতের প্রায় ৪০০টি কবুতর আছে। যার বাজারমূল্য ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে গিরিবাজ কবুতরের দাম ও চাহিদা দুই–ই বেশি। টেডি, কামাগার, গোল্ডেন, বাটেরা ও লাখা প্রজাতির কবুতরও আছে। তাঁর খামারের এক জোড়া কবুতরের দাম দুই হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।

কবুতর পোষার বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেননি জানিয়ে রাজু রায় বলেন, লালন–পালন করতে করতেই শিখে নিয়েছেন কবুতর ও পাখির মনমেজাজ, কোন আবহাওয়ায় কোন ধরনের সতর্কতা ও যত্ন দরকার। নিজেই গম, ভুট্টা, সবুজ মুগ, সূর্যমুখী, ধান, বাদাম, ছোলা, কাজরা, চিনা, বাজরা ইত্যাদি কিনে খাদ্য তৈরি করেন। একটি কবুতর এক দিনে গড়ে দুই থেকেতিন টাকার খাবার খায়। প্রতি মাসে কবুতরের খাবার বাবদ ১৫ হাজার টাকা ও ওষুধ বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয় তাঁর। বর্তমানে কবুতর বিক্রি থেকে তাঁর মাসিক গড় আয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।