ফাইল আটকে রাখায় এমপিও পাচ্ছেন না দেড় হাজার শিক্ষক

বরিশাল বিভাগের ৬০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত দেড় হাজার শিক্ষক দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা সংবাদ সম্মেলন করেন। শনিবার দুপুরে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলেনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিভাগের ৬০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দেড় হাজার শিক্ষক ছয় মাস থকে তিন বছর পর্যন্ত বেতন-ভাতার সরকারি অংশ (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিও) পাচ্ছেন না। এসব শিক্ষকেরা কেউ প্রতিষ্ঠান বদল করেছেন, আবার কেউ পদোন্নতি পাওয়ার পর স্কেল পরিবর্তনের কারণে নতুন করে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় থেকে আবেদনের ফাইল না ছাড়ায় বেতন-ভাতার সরকারি অংশ দীর্ঘদিন ধরে পাচ্ছেন না। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা।

আজ শনিবার দুপুর ১২টায় বরিশাল বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত এই শিক্ষকেরা এমন তথ্য জানান এবং তাঁদের মানবেতর জীবনযাপনের বর্ণনা দেন। অবিলম্বে তাঁদের বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা না করা হলে অনশনসহ কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা।

সংবাদ সম্মেলনে এমপিও-বঞ্চিত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী বিভাগীয় কমিটির পক্ষে আহ্বায়ক আবদুল জব্বার খান লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এ সময় বরিশাল আঞ্চলিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ এবং ভুক্তভোগী শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন উপজেলার ২২ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিভাগীয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ফাইলগুলো দিনের পর দিন আটকে রাখেন। এমনকি তুচ্ছ কারণে ফাইল বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে এই শিক্ষকেরা চাকরি করলেও এমপিও থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকেরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ফাইল আটকে দেওয়ার অভিযোগ আনেন।

শিক্ষক সমিতির বরিশাল আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা স্কেল পরিবর্তন বিষয়ে ৩৮ ধরনের কাগজপত্র লাগে। ফলে প্রক্রিয়াটি মারাত্মক জটিলতায় রূপ নিয়েছে। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে আবেদনগুলো বাতিল করায় শিক্ষকেরা অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের বেতন-ভাতা আটকে থাকে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিষয়টির সুরাহা হলেও বরিশাল বিভাগে এটি আটকে দেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার মরিচবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. লিয়াকত আলী জমাদ্দার। নিজের দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের ১ জুন থেকে আমি এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এর আগে একই উপজেলার আমড়া বুনিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলাম। কিন্তু নতুন কর্মস্থলে যোগদানের পর গত ৯ মাস আমি কোনো সরকারি বেতন-ভাতা পাচ্ছি না।’

হয়রানির বিষয়টি আমি শুনেছি। উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের কাছে হাইস্কুলের এত ফাইল আটকে আছে, এটা আমিও জানি না। একজন শিক্ষক আগে বেতন-ভাতা পেতেন, এখন কেন তাঁদের বেতন-ভাতা বন্ধ থাকবে? এটা কাম্য হতে পারে না। আমি এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরব।
মোয়াজ্জেম হোসেন, পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চল

লিয়াকত আলী জমাদ্দার বলেন, ‘আমি চাকরিজীবনে এ পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছি। যতবার নতুন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে, ততবার নতুন করে এমপিও হয়েছে। কিন্তু এবার শেষবারে গত ৯ মাস কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। ইতিমধ্যে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে, আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আর্থিকভাবে ব্যাপক ধারদেনায় জর্জরিত। এখন পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। এমনকি আমার ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর থেকে আর খারাপ কী অবস্থা হতে পারে?’ এসব বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

একইভাবে ঝালকাঠির নলছিটির হাজি এম এ রশিদ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নলছিটি পঞ্চগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ সালের ৭ জুলাই নতুন নিয়োগ পান সহকারী শিক্ষক মো. হুমায়ূন কবির। এরপর প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি তিনি বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন ‘আগে বেতন-ভাতা পেলেও নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো কাজ হচ্ছে না।’

বিক্ষুব্ধ শিক্ষকদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ঝালকাঠির নলছিটি, কাঁঠালিয়া, বরিশাল সদর, পিরোজপুরের নেছারাবাদসহ বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার ৬০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৫০০ শিক্ষক ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত বেতন-ভাতাবঞ্চিত। কনিষ্ঠ থেকে জ্যেষ্ঠতা পাওয়া কিংবা এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পর নতুন করে এমপিওভুক্তির ফাইল না ছাড়ায় এই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য তাঁরা বিভাগীয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ফাইল আটকে দেওয়ার অভিযোগ আনেন।

জামাল হোসেন নামের বিক্ষুব্ধ আরেক শিক্ষক জানান, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরে বছরখানেক ধরে ছোটাছুটি করে আমরা ২২ জনের ফাইল ছাড় করাতে পারলেও এখনো অন্তত দেড় হাজার শিক্ষক এই সমস্যায় আছেন। অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক এমপিওভুক্তির আবেদন ফাইলগুলো ছাড় না দেওয়ায় এসব শিক্ষক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।’

বিক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা জানান, শিগগিরই এসব শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদনের ফাইল ছাড় দেওয়া না হলে ঈদের পর তাঁরা অনশন ও শিক্ষা কার্যালয় কার্যালয় ঘেরাও করার কর্মসূচি দেবেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘হয়রানির বিষয়টি আমি শুনেছি। উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের কাছে হাইস্কুলের এত ফাইল আটকে আছে, এটা আমিও জানি না।’ তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষক আগে বেতন-ভাতা পেতেন, এখন কেন তাঁদের বেতন-ভাতা বন্ধ থাকবে? এটা কাম্য হতে পারে না। আমি এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরব।’