‘য্যাতে হাত দেবেন, হেইতেই দাম আর দাম’

বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবজি ব্যবসায়ী মো. শহীদ। বুধবার রাতে বরিশাল নগরের চৌমাথা বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

ক্রেতা নেই দোকানে। বিষণ্ন মুখে নিজের দোকানে বসে ছিলেন প্রায় ৬০ বছর বয়সী মো. ইসমাইল। বাজার ফাঁকা, লোকজনের উপস্থিতি কম। এমনিতে বরিশালের কাঁচাবাজারে রাতে ভিড় একটু বেশি থাকে। তবে বুধবার রাতে নগরের চৌমাথা, নথুল্লাবাদসহ অন্য বাজারগুলোয় ভিড় চোখে পড়ল না।

নগরের চৌমাথা বাজারে মো. ইসমাইলের মুদিদোকান। দোকানে বসে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘মাল-জিনিসের দাম যেইভাবে বাড়ছে, হ্যাতে মানষে বাজারে আইবে ক্যামনে? দ্যাহেন না বাজার মরা। য্যাতে হাত দেবেন, হেইতেই দাম আর দাম।’  

১০ বছর ধরে বাজারে মুদিদোকান করছেন মো. ইসমাইল। তাঁর বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায়। ইসমাইল জানান, তাঁর দোকানে আগে প্রতিদিন ১৫–২০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। তা দিয়ে তিন সন্তান ও স্ত্রী মিলে পাঁচজনের সংসার সচ্ছলভাবেই চালাতে পারতেন। কিন্তু এখন আর চলে না। বছর ধরে নিত্যপণ্যের যে দাম বেড়েছে, তাতে দিনে সাত–আট হাজার টাকাও বিক্রি হয় না।

বিক্রি কমে যাওয়ায় আয়ও কমে গেছে ইসমাইলের। মাসে দোকান ভাড়া পাঁচ হাজার, বাড়িভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিল, সংসারের ব্যয়, সন্তানদের পড়াশোনা ব্যয়সহ অন্যান্য মিলিয়ে মাসে ৬০ হাজার টাকা লাগে তাঁর। আগে ৪০ হাজারে হয়ে যেত, কিন্তু এখন ব্যয় দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু আয় কমে যাচ্ছে। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ইসমাইল। ব্যবসা টেকাতে সাড়ে তিন–চার লাখ টাকা ঋণ করেছেন। তবু কুলাতে পারছেন না। দুশ্চিন্তায় এখন আর রাতে ভালো ঘুম হয় না ইসমাইলের।
আক্ষেপ করে ইসমাইল বলেন, ‘হারাদিন বইয়্যা থাহি, বেচাকিনা কই। আর মন চায় না এই ব্যবসা করি। কিন্তু, করমু কী? না পারি রিকশা চালাইতে, না পারি বোঝাবিড়া টানতে, এক্কেবারে মরণদশা এহন।’

কেন এমন হলো—এমন প্রশ্নে কপালে ভাঁজ ফেলে বড় করে তাকান ইসমাইল। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে উঁচু স্বরে বললেন, ‘বোঝেন না, ক্যা বাড়ছে? আপনে কি বাজার-সওদা করেন না?’ গলার স্বর নিচু করে এবার তিনি বলেন, ‘আমি দোহানদার। কিন্তু আমারও তো প্যাট আছে, খিদা আছে, সোংসার আছে। মানষেরে দোষ দিয়া কী লাভ? মানষে টাহাডা পাইবে কই? মাল-জিনিসের দাম যেই রহম বাড়ছে, হেই রহম কি মানষের আয় বাড়ছে, বরং কমছে। এহন যে আয়, হ্যাতে সোংসার চালানো দায়।’

ত্যালের (জ্বালানি) দাম যে বাড়া বাড়ছে, হ্যাতে এহন মৌসুম-অমৌসুম বইল্লা কিচ্ছু নাই। রাইত পোয়ালেই দাম বাড়ে।
মো. শহীদ, সবজি বিক্রেতা

কথার ফাঁকে একজন ক্রেতা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেঁয়াজ কত?’ হাসি দিয়ে ইসমাইল বললেন, ‘৩৩ টাহা কেজি। তিন কেজি ১০০ টাহা রাখমু আনে।’ ক্রেতা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘হ্যাতে আর লাভ কী, যেউ লাউ হে কদু।’

পেঁয়াজ বাছাই করে পাল্লায় দিতে দিতে সেই ক্রেতা বলছিলেন, ‘বাজারে আইলে কান্দন আয়, পকেটে যে টাহা লইয়্যা আই, হ্যাতে অর্ধেক সদায়ও নেতে পারি না। মাছ-মাংসের গায়ে তো হাতই দেতে পারি না। জীবন যে ক্যামনে চলবে, কইতে পারি না।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ক্রেতা-বিক্রেতার এমন আক্ষেপ সাধারণ মানুষের মধ্যে। বাজারের আনাচকানাচ ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-কষাকষি বেশ টের পাওয়া গেল। চৌমাথার কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রেতা মো. শহীদ ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। জীবনে দেখেননি ২০ টাকার সবজি কিনতে ক্রেতাদের এত দর-কষাকষি। শহীদ বলেন, ‘চেনা মানুষরেও এহন ক্যামন অচেনা লাগে। দাম হুইন্না কী সব কথা কয়, বুঝাইতে পারমু না। মানুষের মেজাজ এহন ঠিক নাই।’  

বিক্রি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মুদিদোকানি মো. ইসমাইল। বুধবার রাতে বরিশাল নগরের চৌমাথা বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

শহীদের ব্যবসায়েও এখন ভাটা। আগে যেখানে প্রতিদিন পাঁচ–সাত হাজার টাকা বিক্রি করতেন। এখন তা কমে দু–তিন হাজারে নেমেছে। সংসার আর চলছে না। ধারদেনায় ডুবুডুবু। দিনে ৫০০ টাকা আয় করে সংসার চালাবেন, নাকি ঋণের কিস্তি টানবেন, কূল পান না। শহীদ বলেন, ‘না খাইয়া তো আর মানষে বাঁচতে পারে না। তয় আগে যা খাইতো হ্যার চাইতে কম খায় এহন, বাঁচতে তো অইবে।’

বাজারে ৪০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি নেই। পালংশাকের প্রতি আঁটি ২০ টাকা। শীতের শেষ তবু সবজির দামে হেরফের নেই। শহীদ বলেন, ‘হেরফের অইবে ক্যামনে, সব সবজি আয় (আসে) যশোর, খুলনা গোনে ট্রাকে। ত্যালের (জ্বালানি) দাম যে বাড়া বাড়ছে, হ্যাতে এহন মৌসুম-অমৌসুম বইল্লা কিচ্ছু নাই। রাইত পোয়ালেই দাম বাড়ে।’

মো. শহীদ সিঅ্যান্ডবি রোডের কেরানি বাড়ি সড়কে বাস করেন। দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার। আগে এই ব্যবসায় যে রোজগার ছিল তাতেই চলে যেত। এখন আর চলে না। এখন ধারদেনা করে কোনো রকম টিকে থাকার লড়াই করছেন। এরই মধ্যে ৬০ হাজার টাকা ঋণী হয়েছেন। এতে মাসে ছয় হাজার টাকা কিস্তি টানতে হয়। এরপর দৈনিক ১০০ টাকা খাজনা, বিদ্যুৎ বিল ২০ টাকা, হাটের পরিচ্ছন্নতা, পানির জন্য দিতে হয় ৫০ টাকা। এরপর নিজের পকেট খরচ সব মিলিয়ে যা লাভ, তার বড় অংশ এতেই চলে যায়। শহীদ বলেন, ‘বাজারের যে অবস্থা, হ্যাতে এ ঠ্যালার পানি ও ঠ্যালায়, আবার ও ঠ্যালার পানি এ ঠ্যালায় আইন্না কোনো রহম বাঁইচ্চা আছি, এইয়্যা ছাড়া আর উপায় কী।’