রাজশাহীতে ওএমএসের চাল-আটা কিনতে কেউ রাত ১২টা, কেউ ভোররাত থেকে লাইনে

রাজশাহীতে ওএমএসের চাল ও আটা কেনার জন্য রাত থেকে অপেক্ষা করেন ক্রেতারা। সকাল ৯টা থেকে ট্রাকে পণ্য বিক্রি হয়। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের চৌদ্দপাই এলাকায় তোলাছবি: প্রথম আলো

বাজারের উচ্চ মূল্যের বিপরীতে অর্ধেক দামে চাল ও আটা কিনতে রাজশাহীতে সরকারি খোলাবাজারের (ওএমএস) ট্রাকের সামনে ভিড় করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সকাল ৯টায় ট্রাক এলেও অনেকেই পণ্যের আশায় রাত ১২টা বা ভোররাত থেকে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। রাজশাহী নগরের চৌদ্দপাই এলাকায় এমনই এক চিত্র দেখা গেছে, যেখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও অনেকে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন।

রাজশাহী নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে সাপ্তাহিক ছুটি বাদে পাঁচ দিন প্রতি ট্রাকে এক টন চাল ও এক টন আটা বিক্রি করা হয়। একজন প্রতি কেজি ৩০ টাকায় সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল এবং প্রতি কেজি ২৪ টাকায় একই পরিমাণ আটা কিনতে পারেন।

রাত তিনটার দিকে এসে লাইন ধরে অবস্থান করছিলেন নগরের বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা রোজেনা বেগম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চাল ও আটা কেনার সুযোগ পান। তিনি বলেন, ‘অ্যাকটা মানুষ কাইজ করেন। চাইরটা-পাঁচটা মানুষ খায়। কী করব, ওই একজনের আয়ে কিছু হয় না। আইসতে তো হবেই। তা ছাড়া তো বুদ্ধি নাই। আমরা গরিব মানুষ। অনেক দিন পাওয়া যায় না। তাই রাতে আসি।’

রাত দুইটার দিকে লাইনে দাঁড়ান নগরের মির্জাপুর এলাকার সোনাবান বেগম। তিনি লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করেন। দুই ছেলে মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘গতকালকে সকাইলে আইছিলাম। আইসা পাইনি। পরে আজ দুইটায় আইসিছিলাম। এখানে আইসে বসেছিলাম।’

ফজরের আজানের পর লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন হনুফার মোড়ের চায়না বেগম। কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, ‘একটু বেশি করে বাড়ায় দিক। আমরা একা খেতে চাইনি। আমরা কারও হক মারতে চাইনি। বাংলাদেশের সবাই খাব। কেউ খাবে, কেউ খাবে না, এটা তো আমরা চাইনি। আল্লাহকে স্মরণ করলে কেউ কারও হক মারতে পারে না। কিন্তু হক মারছে। সবাই আমরা খেতে চাই।’

লাইনে দাঁড়ানো অধিকাংশ ব্যক্তিই পরিবারের বয়স্ক বা প্রবীণ সদস্য। বেশির ভাগ মানুষের হাতে টুল, পিঁড়ি বা ইট-পাথরসহ ব্যাগ দেখা গেছে। এসব রেখে বা এসবে বসে তাঁরা রাত পার করেন সকালের অপেক্ষায়। তবে লাইনে প্রবীণ নারীদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দেখা গেছে প্রবীণ পুরুষদের।

ওএমএসের ট্রাক থেকে একজন প্রতি কেজি ৩০ টাকায় সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল এবং প্রতি কেজি ২৪ টাকায় একই পরিমাণ আটা কিনতে পারেন। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের চৌদ্দপাই এলাকায় তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভোর পাঁচটার দিকে এসেছেন মো. ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভোরে না আইসলে চাল-আটা পাওয়া যায় না। না পাইলে চইলে যাব।’ ইমদাদুল হক নামের এক ব্যক্তিও পুরুষদের লাইনের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সকালবেলা এসেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে এখানে রাতে এইসে ঘুমায়। এখানে কেউ পাবার আশায় বসে আছে। কেউ পাবে না, তা–ও বসে আছে। আমরা আছি লাইনে, যদি পাই পাইলাম, আর না পাইলে অন্য দিন আগে আসব।’

চৌদ্দপাই এলাকার ডিলার শামীম হোসেন জানান, ‘আমরা শুনেছি রাত ১২টা, ১টার দিকে তাঁরা আসেন। অনেক নিষেধ করেছি, তা–ও তাঁরা রাতে আসেন। এই ওয়ার্ড অনেক বড়। এ কারণে এখানে প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ মানুষ আসেন। বাইরে দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি। এখানে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায় কি না, এ ব্যাপারে আমরা বলেছি।’

উপ-খাদ্য পরিদর্শক মো. রিপন আলী এই স্থানে তদারক করছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাত থেকে যাঁরা এখানে এসে চাল-আটার জন্য বসে থাকছেন, তাঁদের চাহিদা আছে। দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে আছে। তাঁদের কাজও নেই। এখানে অর্ধেক দামে তাঁরা চাল-আটা পাচ্ছেন। আমাদের নিয়ম হচ্ছে, যিনি আগে লাইনে থাকবেন, আগে তাঁদের পণ্য দেব। কিন্তু দেখা গেছে, অনেক মানুষ ১২-১৪ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে যে আমরা দিতে পারি, এটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, লোকসমাগম অনেক বেশি। এখানে সর্বোচ্চ ২০০ জনকে দেওয়া যাবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, এই এলাকায় পণ্যের জোগান বাড়ানো যায় কি না। তবে সেটা ডিলারের চাহিদার আবেদন জমা হলে।’

দুপুরের আগেই এই এলাকার চাল-আটা শেষ হয়ে যায়। সকালে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ফিরে গেছেন খালি হাতে। চৌদ্দপাই এলাকায় এক নারী মুখে কাপড় দিয়ে ঢেকে দাঁড়িয়ে কয়েকজনকে আকুতি–মিনতি করছিলেন চাল-আটা পাওয়া যায় কি না জানতে, কিন্তু ততক্ষণে ট্রাকের সব পণ্য শেষ হয়ে গেছে।