সামর্থ্য নেই, তারপরও বাধ্য হয়ে কিনতে হয় গাইড বই
হযরত আলী ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পড়ে ভোলা সদরের কন্দর্পপুর গ্রামের ওবায়দুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ২০২২ সালে মাছ ধরতে গিয়ে তার বাবা কামাল হোসেন মেঘনা নদীতে মারা যান। নদীগর্ভে বিলীন হয় তাদের ঘরবাড়ি। মায়ের সঙ্গে সে আশ্রয় নেয় মামার বাড়িতে। এই দারিদ্র্যের মধ্যেও মা শাহিনুর বেগমকে ছেলের জন্য ১ হাজার ৯৫০ টাকা দিয়ে এক সেট গাইড ও গ্রামার বই কিনতে হয়েছে।
শাহিনুর বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এত টাকা খরচ করা তাঁর পক্ষে কঠিন। কিন্তু শিক্ষকদের চাপাচাপির কারণে তিনি কিনতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া টাকার অভাবে ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতে না পারার কষ্ট আছে তাঁর।
আরেক অভিভাবক ভোলার ধনিয়া ইউনিয়নের নবীপুর এলাকার হাসিনা বানু (৩০)। সংসারের কাজের পাশাপাশি বাসায় তিনি হোগলাপাতার রশি বুনে কিছু আয় করেন। এতে তাঁর দিনমজুর স্বামী মনিরুল ইসলামের একটু উপকার হয়। তাঁদের মেয়ে লিমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ের জন্য বাধ্যতামূলক গাইড বই কিনতে হবে। কিন্তু ঘরে টাকা না থাকায় বাধ্য হয়ে বিয়েতে পাওয়া নাকফুল তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে মেয়ের জন্য গাইড বই কিনেছেন। তাঁর ইচ্ছা, মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। তাই এত লড়াই।
শিক্ষার্থীদের জন্য গাইড বই কেনা এতটাই জরুরি কি না—জানতে চাইলে ভোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক এবং মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক শরমিন জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে নিরুৎসাহিত করে আসছি। গাইড থেকে উত্তর দিলে নম্বর কমিয়ে দিই। আমরা যে প্রশ্ন করি, তাতে গাইড বইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। পাঠ্যবই পড়লে, শ্রেণিশিক্ষক পড়ানোর সময় নিজস্ব জ্ঞান যোগ করলে সেটাই যথেষ্ট। ইচ্ছা করলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পক্ষে পাঠ্যবই ও সিলেবাস এক-দুই মাসে শেষ করা সম্ভব। প্রাইভেটও পড়তে হয় না।’
একই মত আবদুল মান্নান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ও প্রশিক্ষক মো. সিদ্দিকুল্লাহর। তিনি বলেন, সরকারি পাঠ্যবইয়ে আরও সমৃদ্ধ উপাদান যোগ করা দরকার। প্রতিটি পাঠের শেষে সমার্থক-বিপরীত শব্দ ও মডেল প্রশ্ন রাখা গেলে আলাদা গাইড বইয়ের প্রয়োজন পড়ত না।
ভোলা সদরের ৬৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ফুলকুঁড়ি পাবলিকেশন্সের গাইড বই ৩৯টি, পাঞ্জেরীর ৭টি, অক্ষরপত্র (অ্যাডভান্স) প্রকাশনীর ১০টি এবং লেকচার পাবলিকেশন্সের গাইড বই অন্তত কয়েকটি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে চালু আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শিক্ষকেরা বলছেন, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চাইলে গাইড বই কিনতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বাকি শ্রেণিগুলোতে গাইড বই বাধ্যতামূলকভাবে কেনানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ভোলা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার ফজলে গোফরান বলেন, গাইড বই ছাপা ও বিক্রি নিষিদ্ধ। সেখানে শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা গুরুতর অপরাধ। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি সম্পূর্ণ গাইড বইয়ের সেট কিনতে খরচ পড়ে ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত।
গত ২৩ জুলাই ভোলা পৌর এলাকার টাউন কমিউনিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন শ্রেণিতে ৭৪ শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মধ্যে দিনমজুর ১২ জন, রিকশাচালক ৫, বর্গাচাষি ৪, স্বর্ণকার একজন, বেকার দুজন, আমিন (জমি পরিমাপ করেন) ৩, এনজিওতে চাকরি করে ৯, প্রবাসী ৩, সরকারি চাকরীজীবী ৮ ও ব্যবসায়ী ২৭ জন। একই দিন রাজাপুর ইউনিয়নের ওবায়দুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ২৭২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ জন এতিম, ৪১ জনের অভিভাবক দিনমজুর, ৪২ জনের অভিভাবক জেলে ও ৬৪ জনের অভিভাবক কৃষক। অনেকেই স্বল্প আয়ের মানুষ।
এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করার বিষয়ে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্লাসে পাঠ্যবই রেখে গাইড বই পড়ানো হয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি হয় গাইড বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর ধরে। বই বিক্রেতারা ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের চাপ দিয়ে গাইড বই বিক্রি করেন। অনেক শিক্ষক এতে মৌন সমর্থন দেন, বিশেষ করে যাঁরা প্রাইভেট পড়ান।
তাঁদের অভিযোগ, গাইড বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ভোলার একাধিক শিক্ষক সমিতি, কিছু শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকেরা অভিভাবকদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করছেন। এতে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বও চলছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।
কয়েকজন সহকারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধান শিক্ষক টাকা নিয়ে তাঁদের হাতে কয়েকটা গাইড বই তুলে দেন। ছাত্ররা যেন গাইড কেনে, সে জন্য চাপ দিতে বলেন। গাইড বই অনুযায়ী প্রশ্ন করার জন্যও তাদের চাপ দেওয়া হয়। যেসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান না, তাঁদের প্রশ্নপত্র “অপ্রাসঙ্গিক” বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বুকলিস্ট ও সিলেবাস পৌঁছে দেওয়া হয়, যাতে প্রকাশনী ও পরিবেশকের নাম থাকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে পরিবেশকেরা বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে চাপ দেয়। বই বিক্রেতারা গাইড বইকে ‘ক্লাসে পাঠ্য’ বলে উল্লেখ করেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, গাইড বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ভোলার একাধিক শিক্ষক সমিতি, কিছু শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকেরা অভিভাবকদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করছেন। এতে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বও চলছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোলা সদরের ৬৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ফুলকুঁড়ি পাবলিকেশন্সের গাইড বই ৩৯টি, পাঞ্জেরীর ৭টি, অক্ষরপত্র (অ্যাডভান্স) প্রকাশনীর ১০টি এবং লেকচার পাবলিকেশন্সের গাইড বই অন্তত কয়েকটি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে চালু আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফুলকুঁড়ি পাবলিকেশন্সের বিক্রয় প্রতিনিধি ইউসুফ দেওয়ান বলেন, ‘আমাদের লোকজন কোরবানির ঈদের আগে সিলেবাস দিয়ে গেছে। এরপর আর কেউ যাননি।’ তাঁর বক্তব্য, ‘ফুলকুঁড়ির গাইড বই ভোলার ৩৯টি বিদ্যালয়ে পাঠ্য করা হয়েছে।’
অ্যাডভান্স পাবলিকেশন্সের বিক্রয় প্রতিনিধি আবদুল আহাদ বলেন, ‘ঠিক আছে আপনার কথা, কিন্তু চাপ তো দিই না। কালকে সাক্ষাতে কথা অইবে।’ এই বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
পাঞ্জেরীর প্রতিনিধি এম এম সোহাগ মিয়া বলেন, ‘এটা অন্য কোম্পানির গাইড। আমরা বাধ্য করি না।’ আর লেকচার পাবলিকেশন্সের রিপন ডাকুয়া বলেন, ‘নোট–গাইড খারাপ কী? আমরাও তো পড়েছি।’
তবে ওবায়দুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকসানা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের সব অভিভাবকের পক্ষে নোট-গাইড কেনা সম্ভব হয় না। নোট–গাইড ব্যবসায়ীরা আসেন, ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের সামনে নোট-গাইড কেনার জন্য প্রচার করেন, কিন্তু কেনার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন বলে জানি না। আমি বা আমার কোনো শিক্ষক এ ব্যাপারে কোনো চাপ প্রয়োগে নেই।’
ভোলা জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মেজবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেউ কোনো চাপ দেয় না। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমতো গাইড বই কেনে। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।