জেলার রাজনীতি—১৩: লক্ষ্মীপুর
আওয়ামী লীগে দুই নেতার দাপট, সংগঠিত বিএনপি মামলার চাপে
বিএনপির রাজনীতিতে বছর দুয়েক আগেও বড় বাধা ছিল অনৈক্য। দুই বছর ধরে দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। তবে নেতারা মামলায় বিপর্যস্ত।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীপুরের চারটি সংসদীয় আসনই ছিল বিএনপির দখলে। তাই এই জেলাকে দলটির দুর্গ বলে মনে করতেন নেতা-কর্মীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে চারটি আসন বিএনপির হাতছাড়া হয়। অবশ্য এই নির্বাচনে অংশই নেয়নি বিএনপি। এর পর থেকে জেলার রাজনীতিতে দাপট চলছে আওয়ামী লীগের।
২০১৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে মিয়া গোলাম ফারুক এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নুরউদ্দিন চৌধুরী দায়িত্ব পান। নেতা-কর্মীদের একটি অংশের অভিযোগ, এই দুজন শীর্ষ পদে আসার পর থেকেই ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে পছন্দের লোকদের বসানো হচ্ছে।
আর বিএনপির রাজনীতিতে বছর দুয়েক আগেও বড় বাধা ছিল নেতা-কর্মীদের অনৈক্য। দুই বছর ধরে দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। তবে নেতারা মামলায় বিপর্যস্ত। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশের দুটি মামলায় বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জেলা শাখার আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জেলা শাখার সদস্যসচিব সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
আওয়ামী লীগে তৃণমূলে ক্ষোভ
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী ২০২১ সালের ২১ জুন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন। সভাপতি গোলাম ফারুক লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসন থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁর নাম বাদ দিয়ে ওই আসনের তখনকার সংসদ সদস্য এ কে এম শাহজাহান কামালকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। গত শুক্রবার শাহজাহান কামাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে প্রকাশ্যে কোনো বিভেদ না থাকলেও কমিটি গঠনসহ নানা কার্যক্রমে কোন্দল স্পষ্ট। সম্প্রতি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বেলায়েত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়াসহ কয়েকটি অভিযোগে কেন্দ্রে নালিশ করেন কয়েকজন নেতা। নালিশকারী নেতাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন গোলাম ফারুক। অভিযুক্ত নেতাদের পক্ষ নেন নুরউদ্দিন চৌধুরী।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দায়িত্বে রয়েছেন হুমায়ূন কবির পাটোয়ারী। তিনি নুরুউদ্দিন চৌধুরীর মামা। রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুনুর রশীদ নুরুউদ্দিন চৌধুরীর ভগ্নিপতি। এ ছাড়া দলের অনেক পদে তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা রয়েছেন। নেতা-কর্মীদের একটি অংশ নুরুউদ্দিনের বিরুদ্ধে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের বদলে স্বজন পোষণের অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে নুরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, দলের আদর্শ মাথায় রেখে তিনি রাজনীতি করেন। পদ-পদবি নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ সত্য নয়। তাঁর আত্মীয়রা নিজ যোগ্যতায় পদ পেয়েছেন।
জেলায় দুই দশক আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল পৌরসভার দুইবারের সাবেক মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরকে ঘিরে। মিয়া গোলাম ফারুক ও নুরউদ্দিন চৌধুরী দলের নেতৃত্বে আসার পর থেকেই অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন আবু তাহের। সর্বশেষ পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদের মনোনয়নের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়নি। তাঁর ছেলে জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক এ কে এম সালাহউদ্দিন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এর পর থেকে তাঁকেও দলে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।
১৮ বছর জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ মোজাম্মেল হক ওরফে মিলন। তিনি বলেন, গত বছরের ২২ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। সম্মেলনে জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহাল রাখা হয়। তাঁরা অনেক পরীক্ষিত নেতার নাম বাদ দিয়ে প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। কমিটির পদ নিয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর।
জেলা কমিটির সাবেক ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল কবির বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ এখন আর রাজনীতির মধ্যে নেই, পদ বেচাকেনার মধ্যে চলে গেছে। যাঁর টাকা আছে, তিনি আওয়ামী লীগ; যাঁর টাকা নেই, তাঁর দল করার প্রয়োজন নেই। ইউপি নির্বাচনের সময় আমার কাছেও টাকা দাবি করা হয়েছে। টাকা না দিতে পারায় মনোনয়নের তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেওয়া হয়।’
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিয়া গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, না পাওয়ার বেদনা থেকে এক-দুজন নেতা মিথ্যাচার করছেন। বিগত সময়ের চেয়ে দল এখন অনেক বেশি সুসংগঠিত।
দুর্গ ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি
দীর্ঘদিন ধরে জেলায় তিন ভাগে বিভক্ত ছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তিনটি অংশের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সাহাবুদ্দিন (সাবু)। ২০১৭ সালে দলের সাবেক দুই সংসদ সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এক হন। ২০২১ সালে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও সাহাবুদ্দিনকে সদস্যসচিব করে জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি পালন করছে তিনটি অংশ। দলের উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতেও বিরোধ কমেছে। তবে রামগঞ্জ উপজেলায় কিছুটা বিভক্তি রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলীয় কর্মসূচিতে কিছুটা গতি এলেও মামলার কারণে বিপর্যস্ত দলের নেতা-কর্মীরা। গত ১৮ জুলাই লক্ষ্মীপুরে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খুন হন কৃষক দলের কর্মী সজীব হোসেন। এ ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানায় চারটি পৃথক মামলা হয়। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে প্রধান করে তিন হাজারের বেশি নেতা–কর্মীকে আসামি করা হয়।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাছিবুর রহমান বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের মামলা আছে তিন শতাধিক। এসব মামলায় আসামি ১০ হাজার নেতা-কর্মী। অনেক নেতা কারাগারে, অনেকে এলাকাছাড়া। অনেকে মাঠে থাকলেও গ্রেপ্তারের আতঙ্কে রয়েছেন।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত হলে লক্ষ্মীপুরের সব আসনেই অতীতের মতো বিএনপি জয় পাবে।’
পাপুল কারাগারে, খুনের আসামি আউয়াল
গত সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদরের একাংশ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুল। মানব পাচারে অভিযোগে কুয়েতে তাঁর সাজা হওয়ায় ২০২১ সালে আসনটিতে উপনির্বাচন হয়। বর্তমানে পাপুল কুয়েতের কারাগারে। তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য।
দশম সংসদ নির্বাচনে ১৪–দলীয় জোট থেকে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তরীকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব এম এ আউয়াল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি এ দলের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ‘প্রগতিশীল ইসলামি জোট’ নামে একটি জোটেরও চেয়ারম্যান তিনি। ২০২১ সালের ১৬ মে ঢাকার মিরপুরে সাহিনুদ্দিন (৩৩) নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় আসামি হন আউয়াল। এ ঘটনায় এম এ আউয়াল গ্রেপ্তারও হয়েছেন।