খননে পাওয়া এই মূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুন্দরবনের এক টুকরা ইতিহাস

খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের পরীমালা দেবীর মন্দির। ইট-সিমেন্টের দেয়ালে স্থায়ীভাবে গেঁথে রাখা হয়েছে দেবীর পাথরের মূর্তিছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের উত্তর প্রান্তে কপোতাক্ষ নদ ঘেঁষে আমাদী গ্রাম। এর আশপাশে নদীর ধারে কাদামাটির বুকে নাকি কোনো এক সময় হঠাৎ দেখা মেলে এক পাথরের মূর্তির। গলায় নরমুণ্ডমালা, চার হাতে অস্ত্র। গ্রামের কেউ বলেন, ‘এ চামুণ্ডা দেবী’, কেউ বলেন, ‘আমাদের পরীমালা মা ফিরে এসেছেন।’ তখনো কেউ জানতেন না, এই দেবীমূর্তির কাহিনি।

এই দেবীমূর্তির একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায় সতীশচন্দ্র মিত্রর ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদী গ্রামে বা ইহার সন্নিকটে কোথাও পরীমালা দেবী পূজিত হইতেন...পরবর্তীকালে উহার মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং দেবীমূর্তি ভূমিগর্ভে প্রোথিত হইয়া পড়ে...পরে ভূগর্ভ হইতে পরীমালা দেবীর উদ্ধার সাধিত হইয়াছে।’

সম্প্রতি এক সকালে খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে কপোতাক্ষ নদের তীর ধরে আমাদী গ্রামে গিয়ে চোখে পড়ে পরীমালা দেবীর মন্দির। পিরামিড আকৃতির ছাদ আর ইট-সিমেন্টের দেয়ালে স্থায়ীভাবে গেঁথে রাখা হয়েছে দেবীর পাথরের মূর্তি।

সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টাকীর জমিদার গোবিন্দদেব রায় চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পান—কয়রা নদীর তীরে নারায়ণপুর গ্রামের কাছে খনন করলে দেবীমূর্তি পাওয়া যাবে। তাঁর নির্দেশে খনন করে সত্যিই একটি পাথরের মূর্তি উদ্ধার হয়। লবণাক্ত কাদায় বহু বছর থাকার কারণে মূর্তিটি ক্ষয়ে গেলেও তা চামুণ্ডা বা নরমুণ্ডমালিনী দেবীর রূপ বলে চিহ্নিত হয়। পরে রায় চৌধুরী সেই মূর্তি আমাদী গ্রামে এনে মন্দির নির্মাণ করেন।

কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে কপোতাক্ষ নদের তীর ধরে আমাদী গ্রামে গিয়ে পরীমালা দেবীর মন্দিরের দেখা মেলে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জয় সরদার বলেন, তাঁরা আগের প্রজন্মের মুখে শুনেছেন এই পরীমালা দেবীর গল্প। শুনেছিলেন, আগে মূর্তিটি অনেক বড় ছিল। এখন মন্দিরের দেয়ালের ভেতরে গেঁথে রাখায় শুধু ওপরের অংশই দেখা যায়, তাই ছোট মনে হয়।

স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব মঞ্জু সরদার বলেন, তিনি শুনেছেন, আগে মূর্তিটি নদীর জলে ডুবে ছিল। এক রাজা স্বপ্নে দেখে তুলে এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন জায়গাটায় বুচগাছের বাগান ছিল।

মঞ্জু সরদারের কথা শেষ হতেই ঢোল-করতালের শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পরীমালা দেবী মন্দির চত্বর। একদল নারী-পুরুষ ঢোল–করতাল বাজাতে বাজাতে ঢোকেন মন্দিরে। তাঁদের মধ্যে অমিত ঘোষ নামের এক ভক্ত জানান, তাঁরা এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে, এখানে পূজা দিতে।

ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের উপাধ্যক্ষ ও ‘খুলনার পুরাকীর্তি’ গ্রন্থের লেখক মিজানুর রহমান জানান, আমাদী মন্দিরের পরীমালা দেবীর বিগ্রহটি আসলে বেলেপাথরে খোদাই করা চামুণ্ডা দেবীর মূর্তি।

পরীমালা দেবী মন্দির কমিটির সদস্য তরুণ সরকার বলেন, ‘আমাদের দেবী মায়ের মূর্তিটা সাধারণ কোনো মূর্তি নয়—এটা খুব দামি পাথরের তৈরি। এ কারণেই বহুবার ডাকাতেরা এখানে হামলা চালিয়েছে।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আজও এই মূর্তি দেখতে আসে। আগে এখানে আধা পাকা একটা ঘর ছিল, আর মূর্তিটাও খোলামেলা অবস্থায় রাখা থাকত। প্রায় ৩৫ বছর আগে আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা একসঙ্গে মন্দিরটা পাকা করে তুলি। তারপর মূর্তিটি মোটা রড আর সিমেন্ট দিয়ে দেয়ালে গেঁথে দেওয়া হয়, যেন কখনো হারিয়ে না যায়।’