কক্সবাজারে সাগর উত্তাল, ইলিশ ধরতে পারছে না ৫ হাজার ট্রলার

সাগর উত্তাল থাকায় বড় জেলে নৌকা নামতে পারছে না। ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে উপকূলের কাছাকাছি মাছ করছেন জেলেরা। আজ দুপুরে টেকনাফ উপকূলেছবি: প্রথম আলো

পুরোদমে বর্ষা এসে যাওয়ায় উত্তাল রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এ কারণে কক্সবাজারের অন্তত ৫ হাজার ট্রলার ইলিশ ধরতে সাগরে নামতে পারছে না। উপকূলের কাছাকাছি ছোট ছোট বেশ কিছু মাছ ধরার নৌকা মাছ শিকার করলেও ইলিশের দেখা মেলেনি। সে কারণে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও জেলেরা এখনো লাভের খাতা খুলতে পারেননি। উপকূলের কাছাকাছি সাগরে মাছ শিকার করা জেলেরা লইট্যা, মাইট্যা, গুইজ্যা, তাইল্যা, পোপা, কামিলা মতো মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরছেন। ইলিশও মিললেও সংখ্যায় কম।

আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে কক্সবাজারে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সাগরও প্রচণ্ড উত্তাল। ঢেউয়ের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ে সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত আগের ১২ ঘণ্টায় কক্সবাজারে বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে ৪৮ মিলিমিটার।

জেলেরা জানান, ছোট আকৃতির ট্রলার নিয়ে ৭০-৮০ কিলোমিটার সাগরের গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। ইলিশ ধরতে হলেও সাগরের এমন গভীরতায় কমপক্ষে ৭ থেকে ১২ দিন অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। জেলেরা এখন সাগরের ১০-১২ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরছেন।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ১২ জুন ৫৮ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। কিন্তু এর পরপরই সাগর উত্তাল রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়ায় মাছ ধরার ছোট–বড় ট্রলার আছে ৬ হাজার। এর মধ্যে ৫ হাজার বড় ট্রলার সাগরে নামতে পারছে না। এসব ট্রলারের লাখখানেক জেলে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। তবে দুই দিন ধরে ছোট আকৃতির ১ হাজার ট্রলার ১০-১২ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরছে। প্রতিটি ট্রলারে ছোট-বড় মাছের সঙ্গে ২০-৫০টি করে ইলিশও ধরা পড়ছে।

দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, আষাঢ় ও শ্রাবণ দুই মাস এমনিতে সাগর উত্তাল থাকে। উপকূলের জেলেদের কাছে এ সময়টা ‘প্রাকৃতিক বন্ধ’। আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত টানা দেড় মাস সাগরে এই ‘প্রাকৃতিক বন্ধ’ পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে। এর মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জেলেরা ইলিশ ধরতে সাগরে নেমে পড়বে।

ইলিশ কখন মিলবে

আজ সকাল ১০টায় শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা ফিশারীঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, ১০-১২টি ট্রলার সাগর থেকে নদীর মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে ভিড়েছে। ট্রলারগুলোয় বিভিন্ন রকমের মাছের সঙ্গে অল্প কিছু ইলিশও দেখা গেছে।

এফবি জনি নামের একটি ট্রলারের জেলেরা জানান, সাগর থেকে ফিরে তাঁরা দেড় লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। মাছের মধ্যে রয়েছে মাইট্যা, লইট্যা, ফাইস্যা, গুইজ্যা, কামিলা ইত্যাদি। ট্রলারের মালিক শামসুল আলম বলেন, জালে ২১টি ইলিশ ধরা পড়েছিল। ইলিশগুলো বিক্রি না করে খাওয়ার জন্য বণ্টন করা হয়।

ট্রলারের জেলেরা জানান, বাঁকখালী নদী থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন উপকূলের দিকে গিয়ে তাঁরা জাল ফেলে মাছগুলো ধরতে পেরেছেন। কিন্তু সাগর প্রচণ্ড উত্তাল বলে ইলিশ না ধরে তাঁরা ঘাটে ফিরে এসেছেন। গভীর সাগরে গেলে বিপুল ইলিশ ধরা যেত। আবহাওয়া শান্ত হয়ে এলে জেলেরা ভালো ইলিশ পাবেন বলে আশা করছেন।

জালের ছোট–বড় নানা মাছ পাওয়া গেলেও ইলিশের দেখা মিলছে না সেভাবে। আজ দুপুরে টেকনাফ উপকূলে
ছবি: প্রথম আলো

এফবি রাজিয়া নামের আরেকটি ট্রলারের জালে ধরা পড়েছে ৫৭টি ইলিশ। ইলিশের ওজন দেড় থেকে দুই কেজি। ধরা পড়েছে অন্যান্য প্রজাতির আরও কয়েক মণ সামুদ্রিক মাছ। মাছসমূহ বিক্রি করে জেলেরা পেয়েছেন দুই লাখ টাকা। ট্রলারের জেলে আবুল কাশেম বলেন, ২১ জেলে নিয়ে ট্রলারটি সাগরে নামতে খরচ গেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। মাছ বিক্রি করে খরচের টাকাও ওঠেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে নেমেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইলিশ ধরতে না পারায় কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক, নুনিয়াছটা, পাশের খুরুশকুল, টেকনাফের জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ৩২টি জেলে পল্লিতে এখন চরম খাদ্যসংকট চলছে।

ঢাকা গেল ১০০ মণ ইলিশ

বাঁকখালী নদীর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে থেকে ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছ কিনে ট্রাকবোঝাই করে ঢাকায় সরবরাহ করেন কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য সমবায় সমিতির শতাধিক সদস্য। গতকাল ৫০-৬০টি ট্রলার থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী ৮০ মণ ইলিশ কিনে ঢাকা পাঠিয়েছেন। আজ ১০০ মণ ইলিশ পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমিতির প্রধান উপদেষ্টা ও ইলিশ ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন বলেন, বৈরী পরিবেশে সাগর উত্তাল থাকায় জেলেরা গভীর সাগরে গিয়ে ইলিশ ধরতে পারছেন না। তারপরও কাছাকাছি এলাকায় যেসব ট্রলার মাছ ধরতে যাচ্ছে তাদের জালে ৪০-৭০টি করে ইলিশ ধরা পড়ছে। এ কারণে ইলিশের দাম বেশি। গতকাল প্রতি কেজি ইলিশ ১ হাজার টাকা দরে ৮০ মণ ইলিশ কিনে তাঁরা ঢাকায় পাঠিয়েছেন। আজ প্রায় ১০০ মণ ইলিশের সঙ্গে আরও ৪০০ মণ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ পাঠিয়েছেন তাঁরা।

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় মাছ উৎপাদিত হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ ছিল ৩৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। চলতি বছর ৩৬ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।