শ্রেণিকক্ষের সারি সারি টুল-বেঞ্চ। সেখানে শিক্ষার্থীরা বসেছেন পাশাপাশি। তবে সামনের একটা বেঞ্চ ফাঁকা। তাতে রাখা আছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ দুই শিক্ষার্থীর ছবি। একজন হৃদয় তরুয়া ও অন্যজন ফরহাদ হোসেন। দুজনের ছবির সামনে রাখা ছিল দুটি ফুল।
আজ রোববার দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর ক্লাস শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান। উত্তাল সময়ের পুরোটাজুড়ে ক্যাম্পাস ছিল বন্ধ। দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাসে ফেরার উচ্ছ্বাস ছিল সবার চোখেমুখে। তবে আন্দোলনে নিহত সহপাঠীদের কথাও ভোলেননি শিক্ষার্থীরা। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা সে কথাই জানান দিলেন। প্রথম দিন ক্লাসরুমে না থেকেও যেন ছিলেন বিভাগের দুই শহীদ শিক্ষার্থী।
আজ সকাল সাড়ে ৯টায় জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণের মধ্য দিয়ে শ্রেণির কার্যক্রম শুরু করে কর্তৃপক্ষ। শহীদদের স্মরণে সকাল ৯টা থেকেই শহীদ মিনারে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পরে আলাদাভাবে ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বর্ষের ক্লাস ও পরীক্ষার কার্যক্রমও শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরেছে। সব মিলিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া আমাদের এ মুহূর্তে লক্ষ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, কর্তৃপক্ষ এটি করার চেষ্টা করছে।’
নবীনদের উচ্ছ্বাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রথম ক্লাস। খুলনা থেকে আসা এই শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার ইচ্ছা মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকেই। নতুন জায়গায়, নতুন সহপাঠী, সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছে। এই উচ্ছ্বাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করতে চাই। পড়াশোনা আর মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করবে, এটাই প্রত্যাশা।’
অবশ্য শুধু ইসরাত নয়। তাঁর মতো অন্তত চার হাজার শিক্ষার্থীর ইচ্ছে একই। ৪৮টি বিভাগ আর ৬টি ইনস্টিটিউটের অন্তত ৪ হাজার শিক্ষার্থী আজ বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছেন। দুপুর ১২টায় দেখা যায়, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা দলে দলে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউবা পছন্দসই জায়গায় নিজেকে ছবিতে বন্দী করছেন।
ইতিহাস বিভাগে দুই শহীদকে স্মরণ
গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে চট্টগ্রাম নগরে গুলিবিদ্ধ হন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় তরুয়া। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে নিহত হন একই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ হোসেন। হৃদয় ওই বিভাগের তৃতীয় আর ফরহাদ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আজ অন্য বিভাগের মতো ইতিহাস বিভাগেও নবীনবরণ অনুষ্ঠান ছিল। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে হৃদয় আর ফরহাদকে স্মরণ করেছে বিভাগ। সামনের সারির একটি বেঞ্চ দুই শহীদ স্মরণে খালি রাখা হয়। এ সময় ওই বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়।
জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের সভাপতি শামীমা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, হৃদয় আর ফরহাদের স্মরণে ভিডিও তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছে। নতুন সিলেবাসেও এই দুজন শহীদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই দুজনকে মনে রাখবে ইতিহাস বিভাগ।
তিন মাস পর ক্লাস শুরু
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ছিল গত ১ জুলাই থেকে। ওই দিন থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতিতে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এর ফলে আটকে যায় বিভিন্ন বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষাও। পরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের একপর্যায়ে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। এই নির্দেশনামতে, ১৯ আগস্ট থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিন্ডিকেট। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এ সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। পরে আজ রোববার থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।