শত বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছে প্যারীমোহন গ্রন্থাগার

বই ছাড়াও পাঠকদের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ২০টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ৫টি সাময়িকী নিয়মিত রাখা হয়। সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার এ গ্রন্থাগার বন্ধ থাকে। 

গ্রন্থাগারের মোট বইয়ের ৫০ শতাংশই উপন্যাস। গবেষণাগ্রন্থ আছে ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাসভিত্তিক বই ১০ শতাংশ। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ১০ শতাংশ
ছবি: প্রথম আলো

ভবনের দেয়াল ঘেঁষে বইয়ের বড় বড় তাক। মাঝখানে বসানো লম্বা টেবিলে সারি করে রাখা চেয়ারে বসে আছেন কয়েকজন পাঠক। কেউ বই পড়ছেন, কেউ দৈনিক সংবাদপত্র, কেউবা সাময়িকী। ১১২ বছর ধরে এভাবেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে নওগাঁর প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগার।

নওগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্র পোস্ট অফিসপাড়ায় কেডি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পাশেই এ গ্রন্থাগার। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, দোতলা ভবনের নিচতলায় বিশাল পাঠকক্ষ। পাঠকক্ষের চারপাশে দেয়াল ঘেঁষে ২০-২২টি আলমারিতে থরে থরে সাজানো বই। পাঠকক্ষের উত্তরে ও পশ্চিমে দুটি কক্ষে অর্ধশতাধিক আলমারি ও তাক। সেখানেও সাজানো রয়েছে হাজারো বই। পাঠকক্ষের দক্ষিণে দুটি কক্ষে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর কার্যালয়। দোতলায় রয়েছে একটি মিলনায়তন। এ ছাড়া গ্রন্থাগারের সামনের চত্বরে রয়েছে পুকুর ও উন্মুক্ত মঞ্চ।

গ্রন্থাগার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহে রয়েছে ১০ হাজার বই। মোট বইয়ের ৫০ শতাংশই উপন্যাস, গবেষণাগ্রন্থ আছে ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক বই আছে ১০ শতাংশ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ১০ শতাংশ। বই ছাড়াও পাঠকদের চাহিদা মিটাতে প্রতিদিন ২০টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ৫টি সাময়িকী নিয়মিত রাখা হয়। সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার এ গ্রন্থাগার বন্ধ থাকে। অন্য ছয় দিন প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পাঠকক্ষ খোলা থাকে। গ্রন্থাগারে বর্তমানে আজীবন সদস্য আছেন ৬৭ জন। এ ছাড়া সাধারণ সদস্য রয়েছেন ২১৫ জন।

২০১৭ সাল থেকে গ্রন্থাগারে কাজ করছেন গ্রন্থাগারিক বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, গ্রন্থাগার বর্তমানে পত্রপত্রিকা পড়ার পাঠকই নিয়মিত আসেন। প্রতিদিন ৪০-৫০ জন পাঠক খবরের কাগজ পড়তে আসেন। বই পড়তে আসেন গড়ে ৪০ জন। 

১৯১০ সালে প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন নওগাঁর কৃতী সন্তান জমিদার প্যারীমোহন স্যানাল। গ্রন্থাগারে বসে সংবাদপত্র ও বই পড়ছেন লোকজন
ছবি: প্রথম আলো

সংস্কৃতিকর্মী বিন আলী পিন্টু ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এ গ্রন্থাগারে আসেন। তিনি বলেন, ‘হাইস্কুলে ওঠার পর থেকেই এ গ্রন্থাগারে আমি পড়তে আসি। এখানে দেশি-বিদেশি বহু লেখকের বিখ্যাত বই রয়েছে। বর্তমানে এখানে আমি প্রতিদিন আসি মূলত দৈনিক সংবাদপত্র পড়তে।’

নিচতলায় পাঠকক্ষের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কর্নার। সেখানে একটি গোলটেবিলের এক পাশের চেয়ারে বই পড়ছিলেন বিষ্ণু কুমার দেবনাথ নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘সবে লেখাপড়া শেষ করেছি। এখন চাকরির চেষ্টা করছি। দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি এখানে এসে মাঝেমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই পড়ি। কারণ, এখন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক প্রশ্ন থাকে।’

গ্রন্থাগার সূত্রে আরও জানা যায়, গ্রন্থাগারে বসে বই পড়ার পাশাপাশি চাইলে কেউ বাড়িতে নিয়েও পড়তে পারেন। তবে বাড়িতে নিয়ে বই পড়তে চাইলে তাঁকে গ্রন্থাগারের সদস্য হতে হবে। সদস্য হতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনের ফটোকপি জমা ও ১২০ টাকা সদস্য চাঁদা দিতে হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে গ্রন্থাগার পরিচালনা কমিটির ত্রিবার্ষিক নির্বাচন হচ্ছে। প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগারটির পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি কাজী জিয়াউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন।

মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, গ্রন্থাগারে পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য বর্তমান পরিচালনা কমিটি নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ভবিষ্যতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি গ্রন্থাগারের ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। গ্রন্থাগারটি আরও সমৃদ্ধ করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনুদান নিয়ে নতুন বই কেনা হচ্ছে।

ইতিহাসের পাতা থেকে

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম পাঠাগারগুলোর একটি এবং নওগাঁর প্রথম প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগার। ১৯১০ সালে প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন নওগাঁর কৃতীসন্তান জমিদার প্যারীমোহন স্যানাল। প্যারীমোহন নওগাঁয় একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি টাউন হল ও গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন।

নওগাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত এবং গবেষক মোস্তফা-আল-মেহমুদ রাসেল সম্পাদিত নওগাঁর বরেণ্য ব্যক্তি বই থেকে জানা যায়, প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল ‘প্যারীমোহন টাউন হল ও লাইব্রেরি’। ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগের পর প্যারীমোহন স্যানালের বংশধরেরা কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বাস করতে শুরু করেন। প্যারীমোহন স্যানালের ছেলে রজনী মোহন স্যানাল সেখান থেকে গ্রন্থাগারের দেখভাল করতেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থাগারটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। ওই বছরেই স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে নওগাঁ কো-অপারেটিভ নামের একটি ক্লাব গঠন করা হয়। এ ক্লাবের সদস্যরা গ্রন্থাগারটি টিকিয়ে রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নেন। তাঁরা এর নাম দেন ‘প্যারীমোহন সমবায় (কো-অপারেটিভ) সাধারণ গ্রন্থাগার’। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এ নামেই পরিচালিত হয় গ্রন্থাগারটি। ১৯৯২ সালে এর নাম বদলে প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগার করা হয়। 

নওগাঁর বরেণ্য ব্যক্তি বই থেকে আরও জানা যায়, বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাক্ষী এ গ্রন্থাগার। তৎকালীন প্যারীমোহন টাউন হল ও লাইব্রেরিতে বিভিন্ন সময় উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তি আসতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র, সাহিত্যিক সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ। এ গ্রন্থাগার চত্বরে এসে তাঁরা সভা-সমাবেশও করেছেন। এ ছাড়া দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ইতিহাসের বড় বড় ঘটনার সাক্ষী এ গ্রন্থাগার। জেলার আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগার চত্বর।

গ্রন্থাগার পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজী জিয়াউর রহমান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে নানা সহজ মাধ্যম থাকার পরও এখনো কিছু মানুষ এ গ্রন্থাগারে বই, পত্রপত্রিকা পড়তে আসেন, বাড়িতে বই নিয়ে পড়েন। এটা তাঁদের আশা জাগায়। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন এখানে এসে বই পড়ে, সময় কাটায়, সেটা দেখে খুব ভালো লাগে।

নওগাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি ডি এম আবদুল বারী বলেন, গ্রন্থাগারটিকে আরও আধুনিকভাবে গড়ে তোলা দরকার। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রজেক্টরের ব্যবস্থা থাকা দরকার। যার মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক দিন এখানে শিক্ষণীয় চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা যায়।