একই কাজে পুরুষেরা পান ৪৫০ টাকা, নারীরা ১৮০ টাকা

আলু ও তামাক রোপণ এবং উত্তোলনে নারী শ্রমিকেরাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিকের রয়েছে বিস্তর ফারাকছবি: প্রথম আলো

ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুলায় রান্না চড়িয়ে গৃহস্থালির কাজ করেন রংপুরের তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামের হনুফা বেগম। ঘড়ির কাঁটায় ৮টা বাজতেই টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত, ভর্তা ভরে ছোটেন মাঠের দিকে। গৃহস্থের জমিতে শুরু করেন পুরুষদের সঙ্গে কাজ। বিকেল ৫টায় কাজ শেষ হলে ফেরেন বাড়িতে। দিন শেষে মজুরি পান মাত্র ১৮০ টাকা। অথচ পুরুষ হওয়ায় একই গ্রামের নাজমুল হোসেন হনুফার সঙ্গে কাজ করে এক বেলা খেয়ে পান ৪৫০ টাকা।

হনুফা বেগম বলেন, ‘এক সঙ্গে কাম করি, মজুরি পাই অর্ধেক। ওমাক (পুরুষ) দেয় ৪৫০ টাকা আর হামাক দেয় ১৮০ টাকা। কাম তো হামরা অর্ধেক করি না। তা হইলে মজুরি কেন কম? নারী জন্যে কি হামার পেট খায় না কন? বাজারো জিনিসের যে দাম, দুইটা ছাওয়াক নিয়া এই টাকায় পেট ভরে না।’

উত্তরের জেলাগুলোতে এখন চলছে আলু ও তামাক রোপণের মৌসুম। এই দুই ফসল রোপণ ও উত্তোলনে নারী শ্রমিকই একমাত্র ভরসা। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিকের রয়েছে বিস্তর ফারাক। একজন পুরুষের সঙ্গে আলু রোপণ, মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া, লাঙল টানার কাজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করলেও পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেকের কম মজুরি পান নারী শ্রমিকেরা।

গতকাল সোমবার তারাগঞ্জে ডাঙ্গাপাড়ার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হেক্টর জমিতে আলুবীজ লাগাচ্ছেন সরকারপাড়া গ্রামের আনোয়ারুল হক, শ্যামল সরকার, জুলফিকারসহ কয়েজন কৃষক। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি আলু রোপণে কাজ করছেন শতাধিক নারীর কয়েকটি দল। সেই নারীদের কেউ ফালি টানছেন, কেউ আলুর ফালি বসাচ্ছেন, কেউ আবার সেগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।

স্বামী যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ৪০০ টাকা মজুরি পেতেন। এখন একই কাজ আমি করলে মজুরি অর্ধেকেরও কম। গৃহস্থকে মজুরি কমের কথা বললে বলে, তোমরা নারী তাই মজুরি কম। উপায় না থাকায় পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে কাজ করছি। ১৮০ টাকা মজুরিতে কোনোরকমে একবেলা খেয়ে বেঁচে আছি।
পারুল বেগম, নারী শ্রমিক, তারাগঞ্জ, রংপুর

সেখানে কথা হয় দোলাপাড়া গ্রামের বিধবা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে। চার সন্তানকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার তাঁর একার আয়ে চলে। তিনি জানান, গত বছর ১৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করতেন। এ বছর করছেন ১৮০ টাকায়। নুর জাহান বেগম বলেন, ‘হামার সঙ্গে পুরুষ মানুষ একই কাম করোছি। কিন্ত ওমরা পায় ৪৫০ টাকা, এক বেলার খাবারও পায়। এক বছরে চাল, ডাল, তেল, নুন, তরকারি সউগ কিছুরে দাম দ্বিগুণ হইল। কিন্তু হামার নারীর মজুরি বাড়িল না। খুব কষ্টে সংসার চালাওছি। সরকারের উচিত, হামার কিষানির মজুরি বাড়ানো।’

ফসল রোপণ ও উত্তোলনের সব কাজই নারীরা করেন। তবে মজুরির ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

নুরজাহানের কথা শেষ হতেই কথা বলতে শুরু করেন কসাইপাড়া গ্রামের বিধবা পারুল বেগম। তাঁরও পাঁচ সদস্যের সংসার। পারুল জানান, যে নারীরা মাঠে কাজ করছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। কারও স্বামী মারা গেছেন, কারও কাজ করতে অক্ষম। তাই অভাবের তাড়নায় পরিবারের মুখে দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে তাঁরা নিয়মিত শ্রমিকের কাজ করেন মাঠে।

পারুল বেগম বলেন, ‘স্বামী যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ৪০০ টাকা মজুরি পেতেন। এখন একই কাজ আমি করলে মজুরি অর্ধেকেরও কম। গৃহস্থকে মজুরি কমের কথা বললে বলে, তোমরা নারী তাই মজুরি কম। উপায় না থাকায় পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে কাজ করছি। ১৮০ টাকা মজুরিতে কোনোরকমে একবেলা খেয়ে বেঁচে আছি।’ একই কথা জানিয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি করেন মাঠে কাজ করা জোলেখা, ফরিদা, বুলবুলি, শান্তি বালা, ফেরেজা, সহিদা, অলিমাসহ অন্যান্য নারী শ্রমিকেরা।

ওই মাঠে কথা হয় সরকারপাড়া গ্রামের কৃষক শ্যামল সরকারের সঙ্গে। নারীদের মজুরি কম দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি যে নারীরা ছাড়া আলু রোপণ বা উত্তোলন অসম্ভবপ্রায়। তা ছাড়া নারীরা এখন পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজও করছেন। আমি একাই তো মজুরি বাড়াতে পারি না। সবাই যা দেয়, আমিও তা–ই দিই। হঠাৎ করে আমি যদি মজুরি ১০ টাকাও বাড়িয়ে দিই, আশপাশের চাষিরা এসে বিপত্তি বাধাবে।’

মানব কল্যাণ ঘর নামে স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জেবা নাসরিন বলেন, নারীরা সব সময় অবহেলার শিকার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে পুড়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেও তাঁরা ন্যায্য মজুরি পান না। এখনকার যে বাজারদরের অবস্থা, ১৮০ টাকায় আসলে সংসার চলে না। নারীরা ঘরে যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও। এটা দূর হওয়া দরকার।

তারাগঞ্জের মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহান বলেন, সরকারি কাজ যেমন টিআর, কাবিখা, কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজে নারী-পুরুষ সবাইকে সমান মজুরি দেওয়া হয়। সরকার চেষ্টা করছে বেসরকারি কাজগুলোতেও নারী-পুরুষের যে মজুরি বৈষম্য আছে, তা দূর করতে।