মানুষকে সচেতন করতে আবর্জনা পরিষ্কার করেন দুই প্রবীণ
মৌলভীবাজারের মনু নদের পাড়ে ‘শান্তিবাগ ওয়াকওয়েতে’ অনেক মানুষ এখন সকাল-সন্ধ্যা বেড়াতে আসেন। খোলা আকাশের নিচে একটু স্বস্তির খোঁজে পরিবারের সদস্য, নারী-পুরুষ ও নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসেন এখানে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা বিষয়ে উদাসীন। যত্রতত্র ময়লা ও আবর্জনা ফেলে করা হচ্ছে নোংরা। মানুষকে সচেতন করতে স্বেচ্ছায় এসব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করছেন দুই প্রবীণ ব্যক্তি।
ওই দুই প্রবীণ হলেন কানাডাপ্রবাসী ফুলপ্রেমিক নুরুর রহমান এবং অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ফসল’-এর সম্পাদক মো. আব্দুল খালিক। তাঁদের ভাষ্য, মূলত সুন্দর স্থানটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুরক্ষিত রাখতে এ উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু পৌরসভা কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে না দিয়ে সবাই মিলে যাতে দৃষ্টিনন্দন স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন, ভালো রাখেন, সেই বিষয়ে সবার সচেতনতা বাড়াতে তাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালান।
মনু নদের পাড়ে মনু সেতুর কাছ থেকে মৌলভীবাজার প্রধান ডাকঘর পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মিটার জায়গা দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানটিতে শহরবাসীর সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, খোলা জায়গায় সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে ঘুরতে আসা মানুষের জন্য বসার বেঞ্চ ও শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর একটি ক্যাফেটেরিয়া চালুর অপেক্ষায় আছে।
২০ নভেম্বর বিকেলে শান্তিবাগ ওয়াকওয়েতে গিয়ে দেখা যায়, নানা বয়সের অনেক মানুষ ওয়াকওয়েতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ শেডের মধ্যে বসে আছেন। কেউ ওয়াকওয়ের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউবা নদের দিকে পাকা ঘাটে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, ছবি তুলছেন। এরই মধ্যে নুরুর রহমান ও আব্দুল খালিক হাতে হলুদ গ্লাভস লাগিয়ে ওয়াকওয়ের পাকা হাঁটাপথ থেকে এবং ফুলগাছের গোড়া থেকে বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। সেই আবর্জনা তাঁরা ঝোলার মধ্যে ভরে নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলছেন। এই দুজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ব্যাংকার আশরাফ-উল-আলম। তাঁদের দেখে আরও দু-একজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় হাত লাগান। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালান।
মনু নদের পাড়কে আকর্ষণীয় করতে সামগ্রিক কাজে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আর শান্তিবাগ ওয়াকওয়ে আকর্ষণীয় করতে লাগানো হয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল।
আশরাফ-উল-আলম বলেন, ‘এটি একটি সুন্দর স্থান হয়ে উঠেছে। এখানে প্লাস্টিকজাতীয় কোনো কিছু নিয়ে আসা বন্ধ করতে হবে। কেউ কিছু খেতে চাইলে নির্দিষ্ট ক্যাফেটেরিয়া বা ওয়াকওয়ের বাইরে গিয়ে খেতে পারেন। স্থানটিকে পর্যটনবান্ধব করে তুলতে হবে।’
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, মনু নদের দৃষ্টিনন্দন পাড়ে ‘শান্তিবাগ ওয়াকওয়ে’ মৌলভীবাজার শহরের মানুষের কাছে একটুকরা ‘নিশ্বাসের জানালা’ হয়ে উঠেছে। সকাল হলে অনেক স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ওয়াকওয়েতে হাঁটতে, শরীরচর্চা করতে ছুটে আসেন। বিকেলে ভিড় করেন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁরা দল বেঁধে হাঁটেন, কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে আড্ডা দেন। বিকেলজুড়ে অনেক মানুষ আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। মানুষের আগমনে স্থানটি জমজমাট হয়ে উঠেছে। নানা রকম পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা। এখানে ঘুরতে আসা মানুষ চানাচুর, চকলেট, আইসক্রিম, চিপস, আচার ও সিগারেটের বর্জ্য, পলিথিন ও বাক্স ওয়াকওয়েতে ফেলে রাখেন। আর সেসব পরিষ্কার করেন ওই দুই প্রবীণ ব্যক্তি।
সেখানে আলাপকালে আব্দুল খালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সময় মনু নদের পাড়ের অংশটি ঝোপঝাড়ে ভরে উঠেছিল। হাঁটাচলার আর সুযোগ ছিল না। পৌরসভা স্থানটি দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এটি পৌরসভার একটি ভালো উদ্যোগ। এখানে মন ভালো হওয়ার মতো একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সবাই মিলে স্থানটিকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখা। সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন থাকলে আলাদা করে স্থানটি পরিষ্কারের প্রয়োজন পড়বে না।’
মৌলভীবাজার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, মনু নদের পাড়কে আকর্ষণীয় করতে সামগ্রিক কাজে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আর শান্তিবাগ ওয়াকওয়ে আকর্ষণীয় করতে লাগানো হয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। নদের পাড় ঘেঁষে লাগানো হয়েছে হিজল, করস ও কদমের গাছ।
নুরুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শহরে ফুলগাছ লাগানোর জন্য বছরের বেশির ভাগ সময় দেশেই (মৌলভীবাজারে) থাকি। এখানে অনেক ধরনের ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। আমরা দেখছি, পৌর কর্তৃপক্ষ ডাস্টবিন রেখেছে, সেখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে না। ফলে স্থানটি নোংরা হচ্ছে। একজন মেয়র বা পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষে স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হবে না। আমরা এ কাজ করছি, এতে অন্যরা যদি সচেতন হন, ময়লাটা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলেন, তাহলে সুন্দর স্থানটি সব সময় সুন্দর থাকবে।’