‘মেয়েটা আর আমার কাছে কোনো দিন আবদার করবে না’

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মাদ্রাসা ছাত্রী তানজিনা আক্তার
ছবি সংগৃহীত

তেল দেওয়া চকচকে কালো চুল, একহারা পরিশ্রমী শরীর, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উঠানের এক পাশে বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন। কান্নার দমকে দমকে শরীর বেঁকে যাচ্ছিল। কিন্তু এ কান্নায় যেন শোকের কিছুমাত্র উপশম হচ্ছিল না। যন্ত্রণায় কাতর ষাটোর্ধ্ব মানুষটির নাম মোহাম্মদ আলী, পেশায় কৃষক। আজ বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মাদ্রাসাছাত্রী তানজিনা আক্তারের বাবা তিনি।

আদরের ছোট মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় এই কৃষক। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘পড়ালেখা করে বড় হতে চেয়েছিল মেয়েটা। আমি দরিদ্র মানুষ। তবু মেয়ের আবদার পূরণে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি সব সময়। আজ মেয়েটা চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমার কাছে আর কোনো দিন আবদার করবে না।’

মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়াহেদপুর গ্রামে তানজিনাদের বাড়ির উঠানে স্বজন-প্রতিবেশীদের ভিড়। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মা আর বোনের আহাজারি। সে ঘরের বারান্দায় একটি শীতল পাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে সাদা কাফনে মোড়ানো তানজিনা আক্তারের নিথর দেহ। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগেও উচ্ছল মেয়েটার বিচরণে মুখর ছিল পুরো ঘর। মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে বেপরোয়া লরির ধাক্কায় জীবনপ্রদীপ নিভে যায় মেয়েটির।

আজ সকালে প্রতিদিনের মতো মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বের হয় তানজিনা। তখনো মোহাম্মদ আলী জানতেন না, মেয়ের এই যাওয়াই শেষ যাওয়া। জানলে কি আর যেতে দিতেন? বুক চাপড়ে নিজেকে এই প্রশ্ন করেন তিনি বারবার। একবার যে ভালো করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখা হয়নি আজ।

মেয়েকে হারিয়ে আহাজারি করছেন তানজিনা আক্তারের মা। আজ দুপুরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়াহেদপুর গ্রামে
প্রথম আলো

স্বজনেরা জানান, মেয়েটি ফুটপাত ধরেই হাঁটছিল। ভাঙা পোল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনে হঠাৎ বেপরোয়া গতির একটি লরি এসে ধাক্কা দেয় তাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে গাড়িতেই মৃত্যু হয় তানজিনার।

আজ দুপুরে তানজিনার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, এক করুণ দৃশ্য। তানজিনা স্থানীয় মাওলানা নূর আহম্মদ (রা.) দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। সেই মাদ্রাসার অনেক সহপাঠী এসেছে তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। ক্লাসের এক কোণে বসা চুপচাপ লাজুক মেয়ে বলতে যা বোঝায়, তেমনই ছিল তানজিনা। তার উপস্থিতি সচরাচর বোঝা যেত না। অথচ সেই মেয়েটার অনুপস্থিতিই আজ এভাবে বুকে এসে বিঁধছে সবার।

তানজিনাকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন মাওলানা নূর আহম্মদ (রা.) দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক মো. জাকারিয়া হোসাইন। এক পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয় শিক্ষার্থীর শোকে চোখ মুছছিলেন তিনি। জানতে চাইলে জাকারিয়া বলেন, ‘তানজিনা খুব শান্ত স্বভাবের শিক্ষার্থী ছিল। পড়াশোনায়ও দারুণ আগ্রহ ছিল তার। তার এমন নির্মম মৃত্যুতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–শিক্ষার্থী সবাই শোকাহত। এমন অকাল মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’

বাড়ির উঠানে বসেই কথা হয় তানজিনার বড় ভাই রাকিব হোসেনের সঙ্গে। বোন হারানোর শোকে ভেঙে পড়া রাকিব বলেন, ‘এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তানজিনা ছিল সবার ছোট। পরিবারের সবাই আদর দিয়ে আগলে রাখত তাকে। পড়ালেখায় মনোযোগী ছিল সে। মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে গাড়ির ধাক্কায় আজ চির বিদায় নিয়ে চলে গেল বোনটা। এ যে কী কষ্ট বোঝাতে পারব না।’

মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর তানজিনার বাবা মোহাম্মদ আলী(বামে)। আজ দুপুরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়াহেদপুর গ্রামে
প্রথম আলো

তানজিনাকে চাপা দেওয়া লরির চালক ঘুম চোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে ধারণা কুমিরা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় লরিটি আটক করেছি আমরা। তবে সেটির চালক পালিয়ে গেছেন। ধারণা করছি, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত শিক্ষার্থীর লাশ তার পরিবার নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।’

আজ জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তানজিনা আক্তারকে।