পরিত্যক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখন মাতৃত্বের নিরাপদ আশ্রয়
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চরবেষ্টিত ইউনিয়ন বকুলবাড়িয়া। সেখানকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রটি দুই বছর আগেও ছিল পরিত্যক্ত। ছিল না দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী-ওষুধ। রোগীও আসতেন না। বাধ্য হয়ে প্রসূতি নারীদের যেতে হতো শহরে। তবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সেই চিত্র বদলে গেছে। বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে প্রসূতি নারী ও নবজাতকের চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের সংখ্যা বেড়েছে। পাওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনীয় ওষুধ।
পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে আয়ারল্যান্ডভিত্তিক মানবিক সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’। স্থানীয় সংগঠন নজরুল স্মৃতি সংসদ ও অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটির (আভাস) সহায়তায় ‘উপকূলীয় অঞ্চলে নারী, নবজাতক, শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে অংশীদারত্ব’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি জনসচেতনতা কার্যক্রম ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। এতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান উন্নত হয়েছে।
বকুলবাড়িয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের গত দুই বছরের সেবাপ্রার্থীদের বিবরণী ঘেঁটে দেখা গেল, এক বছরের ব্যবধানে এখানে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৩৫ জন প্রসূতির। গত বছর তা ছিল ১৮ জন। একইভাবে সেবাগ্রহীতা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিয়েছেন প্রায় তিন হাজার নারী-শিশু। গত বছর তা ছিল ১ হাজার ৮১০ জন।
সরেজমিনে দেখা গেল, প্রসূতিসহ অন্যান্য নারী-শিশুদের ভিড়। আগে যেখানে প্রসূতি নারীরা সন্তান প্রসবের জন্য উপজেলা ও জেলা সদরে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের জন্য ছুটতেন, এখন তাঁরা স্বাভাবিক প্রসবের দিকে ঝুঁকছেন। এমনকি অন্য নারীরাও সেবা পেতে প্রতিদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় করছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন, প্রসবোত্তর, নবজাতক ও যৌন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, স্যালাইন, ইনজেকশন, গ্লাভস, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ ২২ ধরনের ওষুধ ও উপকরণ আছে।
পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মানসুরা আক্তারের কথায় সেবার ব্যাপারে জানা গেল। তাঁর স্বামী ঢাকায় চাকরি করেন। সংসারের দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে। বকুলবাড়িয়ার লামনা গ্রামের এই গৃহবধূ বলেন, ‘বাড়ির পাশে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকলে আমাগো কী দশা অইত জানি না।’ তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির পরিদর্শক খাদিজা আক্তারের কাছ থেকে তিনি নিয়মিত রক্তচাপ, খাদ্যাভ্যাস ও বিশ্রাম–সংক্রান্ত পরামর্শ পান। তাঁর সন্তান স্বাভাবিকভাবে এই কেন্দ্রে প্রসব হবে বলে তিনি আশা করেন।
চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বরগুনার আমতলী, তালতলী ও পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রয়োজনে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির পরিদর্শক খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে মানুষ খুব একটা আসত না। জনবল কম ছিল, ওষুধও থাকত না। এখন নিয়মিত সেবা দেওয়া যায়। তাই রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। স্বাভাবিক প্রসবও অনেক বেশি হচ্ছে।’
পরিবর্তনের নেপথ্যে
উপকূলীয় এলাকার নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় আয়ারল্যান্ডভিত্তিক মানবিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড। সংস্থাটি স্থানীয় সংগঠন নজরুল স্মৃতি সংসদ ও অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটির আভাস সহায়তায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি শুরু করে। চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বরগুনার আমতলী, তালতলী ও পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রয়োজনে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, ওষুধ সরবরাহ ও অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে স্থানীয় লোকজনকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সেবার মান বেড়েছে। স্থানীয় লোকজনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী হতে শুরু করেছেন। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসবসহ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩১ জন নারী-শিশু ও কিশোর-কিশোরী বিভিন্ন সেবা নিয়েছেন। রোগীর সংখ্যা এখন দৈনিক তিন গুণ হয়ে ২০ থেকে ৫০–এ দাঁড়িয়েছে।
কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রকল্প পরিচালক শেখ শাহেদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে রোগব্যাধীর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। মা ও শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, ডায়রিয়া ও ত্বকের রোগ এখন অনেক বেশি দেখা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা জরুরি। এ জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও জনগণের সক্রিয় সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, ওষুধের সরবরাহ ও স্থানীয় নেতৃত্বের সক্ষমতা বাড়ানো সময়ের দাবি।
সরেজমিনে দুই দিন
গলাচিপা উপজেলাটি রামনাবাদ, তেঁতুলিয়া, আগুনমুখাসহ বিভিন্ন নদীবেষ্টিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরপাড়ের এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস নিত্যসঙ্গী। এ অঞ্চলের নারীদের ভরসা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রগুলো। গত ১৫ ও ১৬ অক্টোবর পটুয়াখালীর গলাচিপা ও বরগুনার তালতলী উপজেলার চারটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, এসব কেন্দ্র আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শিশু ও প্রসূতি নারীদের ভিড়ে ক্লিনিকগুলো সরগরম।
বকুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গুয়াবাড়িয়া কমিউনিটি ক্লিনিক। মূল সড়ক থেকে এক কিলোমিটার কাঁচা পথ পেরিয়ে ক্লিনিকে যেতে হয়। গিয়ে দেখা যায়, ১৫ থেকে ২০ জন নারী ও শিশু চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকে এসেছেন।
ষাটোর্ধ্ব গোলচে আরা বেগম শরীরের নানা জটিলতা নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। স্বামী মারা গেছেন চার বছর আগে। চার সন্তানই আলাদা থাকেন। সম্পদ বলতে পুরোনো একটা বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। তিনি বলেন, ‘এই ক্লিনিক না থাকলে মনে অয় মইরা যাইতাম। এইহানে আইলে আফায় (স্বাস্থ্য পরিদর্শক) পরীক্ষা করে ওষুধ দেয়। কয় দিন ভালো থাকি। আবার অসুস্থ অইলে আই আবার দেয়।’
শুধু গুয়াবাড়িয়া নয়, বঙ্গোপসাগর তীরের আরেক জনপদ বরগুনার তালতলী উপজেলার প্রত্যন্ত বেহালা কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়েও দুস্থ পরিবারের নারীদের এমন ভরসার কথা শোনা যায়। ১৬ অক্টোবর বেহালা কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, অনেক নারী ও শিশু অসুস্থতা, প্রসূতি পরিচর্যা, পরিবার পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে সেবার জন্য এসেছেনে। নমিতা রানী নামের এক নারী বলেন, ‘মোগো শহরে ডাক্তারের কাছে যাওনের সামর্থ্য নাই। হেইতে এই ক্লিনিকের চিকিৎসার ওপরই ভরসা করতে অয়।’
খুঁড়িয়ে চলছে অন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো
প্রকল্প এলাকার বাইরে দেশের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো চলছে খুঁড়িয়ে। অবকাঠামো সংকটের পাশাপাশি রয়েছে জনবলসংকট। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রজননসেবা সম্প্রসারণে নতুন প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশের ৪ হাজার ৫৭৯টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনার জন্য সম্প্রতি একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
ডিপিপির অগ্রগতির বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, এটি এখনো প্রক্রিয়াধীন। এটা অনুমোদন হলে তৃণমূল পর্যায়ে মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতক ও প্রজননসেবার পরিসর আরও বিস্তৃত হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী ও নবজাতকেরা আরও বেশি সেবা পাবে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, আগে কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। এখন সেবার মান বাড়াতে ক্লিনিকগুলোর পরিচালনায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যুক্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিবছর যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার মধ্যে স্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাশন খাতের একটি বরাদ্দ আছে। আগে তা সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার হতো না। এখন এই বাজেট থেকে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রজননসেবায় অর্থ ব্যয় করা হবে।