মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার
এক যুগ ধরে রেণু উৎপাদন বন্ধ
খামারের আটটি পুকুরের মধ্যে ছয়টি পুকুরে পানি নেই। এসব সমস্যার কারণে রেণু উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ।
এক যুগ ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে নড়াইলের একমাত্র মৎস্যবীজ (রেণু) উৎপাদন খামার। জনবলসংকট, সংস্কারের অভাবসহ নানা সমস্যায় বন্ধ রেণু উৎপাদন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জেলার মৎস্যচাষিরা। অতি দ্রুত খামারটি চালু করার দাবি তাঁদের। খামারের এক কর্মকর্তা বলেন, খামারের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। আর পানিস্বল্পতা একটা বড় সমস্যা।
খামার ব্যবস্থাপকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার মৎস্যচাষিদের সুবিধার্থে ১৯৮২ সালে নড়াইল-যশোর মহাসড়কের বউবাজার এলাকায় প্রায় ৯ দশমিক ৭৫ একর জায়গায় স্থাপন করা হয় মৎস্যবীজ উৎপাদন কেন্দ্র। দুটি হ্যাচারিতে সাদা এবং একটিতে চিংড়ি মাছের রেণু উৎপাদন হতো। ১৯৮৫-৮৬ সালে মাছের পোনা উৎপাদনে অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পায় প্রতিষ্ঠানটি। শুরু থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এর কার্যক্রম ভালোভাবে চালু ছিল। এরপর নানা সমস্যায় কমতে থাকে উৎপাদন। একপর্যায়ে ২০১২ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর তা চালু হয়নি।
গত মঙ্গলবার (২৫ জুন) সরেজমিনে দেখা যায়, খামার ব্যবস্থাপকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জরাজীর্ণ একটি দোতলা ভবন। অফিসকক্ষের ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে দাপ্তরিক কার্যক্রম। পাশেই টিনশেডের আবাসিক ভবন, সেটিও বেহাল। এর একটু সামনে বড় বড় আটটি পুকুর, তার মধ্যে ছয়টি পানিশূন্য। খামারের দক্ষিণ পাশে হ্যাচারির অবকাঠামো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
খামারটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন মো. সেকেন্দার আলী। তিনি বলেন, ‘জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। চারটি পদের দুটি ফাঁকা পড়ে আছে। খামারের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে।’
সেকেন্দার আলী আরও বলেন, এখানকার পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। খামারের পুকুরগুলো বেশি গভীর নয়। তলদেশে বেলে মাটি। বাইরে পানি দিলেও থাকে না। পুকুরে পানিস্বল্পতা একটা বড় সমস্যা। এসব সমস্যার কারণেই মাছের রেণু উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ১২ হাজার ১৪১টি মাছের ঘের রয়েছে। এর মধ্যে কার্প–জাতীয় মাছের ঘের ৬ হাজার ৭৫০টি এবং চিংড়িঘের ৫ হাজার ৩৯১টি। তবে জেলায় এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে কোনো মৎস্য উৎপাদন খামার গড়ে ওঠেনি। সরকারি একমাত্র মৎস্যবীজ উৎপাদন খামারটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে যশোরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হচ্ছে খামারি ও ঘেরমালিকদের। এতে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে, রয়েছে পোনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও।
সদর উপজেলার তারাপুর গ্রামের মৎস্যচাষি মিল্টন শিকদার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ২০১৯ সালে চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রাম তারাপুরে মাছ চাষে যুক্ত হন। বর্তমানে ৪৫ একর জমির ওপর তাঁর ২০টি মাছের ঘের রয়েছে। সেখানে চিংড়ি ও কার্প–জাতীয় মাছের চাষ করেন মিল্টন শিকদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলায় একটি সরকারি মৎস্য হ্যাচারি আছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। তাই আমি যশোর থেকে মাছের রেণু নিয়ে আসি। এতে আমার খরচ অনেক বেশি পড়ে। বেসরকারি হ্যাচারি থেকে আনা রেণুর মানও বেশি ভালো হয় না। আমাদের হ্যাচারিটা ভালো থাকলে আমরা কম খরচে ভালো রেণু পেতাম।’
লোহাগড়া উপজেলার মিঠাপুর গ্রামের শাহিন শেখ বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে বিভিন্ন মাছের চাষ করছেন তিনি। যশোর থেকে মাছের পোনা আনতে হয়। জেলায় যে একটা মৎস্য হ্যাচারি আছে, তা তিনি জানেন না। নড়াইলে যদি ভালো মানের পোনা পাওয়া যেত, তাহলে যশোর থেকে আনা লাগত না। এতে গাড়িপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা কম লাগত।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম বদরুজ্জামান বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে একটি বরাদ্দের আবেদন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অচিরেই এর সমাধান করা যাবে। অবকাঠামো উন্নয়ন করা গেলে এখানে চিংড়ি ও কার্প–জাতীয় মাছের রেণু উৎপাদন করা সম্ভব হবে।