ঈদের সেই দিনগুলো কই

বেশ কয়েক বছর আগেও গ্রামের ছেলেরা ঈদের দিন আনন্দ–আড্ডায় মেতে উঠত। এখন আর আগের মতো আড্ডা হয় না। ঈদের দিন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বেশ কয়েক বছর আগেও ছোট-বড় সবাই ঈদের চাঁদ দেখার জন্য গ্রামের ফাঁকা কোনো জায়গায় বা উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারও চোখে সরু একটি রেখার মতো চাঁদ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত হইহুল্লোড়, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তখন একজন আরেকজনকে দেখাত, ওই মেঘের নিচে, তারপর ডানে, না হয় বাঁয়ে। তারপর পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরব্বিদের সালাম দিয়ে বেড়াত।

মুরব্বিরা মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতেন। চাঁদ দেখে আগের সন্ধ্যাতেই ঈদের আমেজ চলে আসত। ছোট–বড় সবার মধ্যেই মায়ার বন্ধন তৈরি হতো। এই মায়াময় সন্ধ্যার জন্য একটি বছর সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। এই চাঁদ দেখার সংস্কৃতি গ্রাম থেকে একেবারে উঠে গেছে বললেই চলে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামের বাসিন্দা ও একটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন বললেন, তাঁর বেশ মনে আছে, গ্রামের ছোটরা ঈদের চাঁদ দেখে দল বেঁধে ঈদের সালাম করতে আসত। তিনি তাঁদের টাকা দিয়েছেন। এখন আর এই পরিবেশ নেই। সেই চাঁদই আছে কিন্তু সালাম করার সংস্কৃতি উঠে গেছে। কেউ আর চাঁদ দেখে মুরব্বিদেরও সালাম করে না।

গ্রামের ছেলেরা কেন বদলে গেল, কী নিয়ে তারা এখন ব্যস্ত, তা দেখতে সোমবার বিকেলে নওটিকা গ্রামের পাড়ার সরকারবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ওই বাড়ির বড় বৈঠকখানা আর নেই। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা ছোট করে একটি বসার ঘর করেছে। সেই ঘরভরা একদল শিশু-কিশোর। তারা সবাই মুখ নিচে করে বসে আছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারা কেউ মুখ তুলল না। দেখার চেষ্টা করল না, পাশে অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভেতর থেকে একসময় একজন চিৎকার দিয়ে উঠল। ‘মেরে দিলাম।’ পাশ থেকে আরেকজনের একই চিৎকার। কিন্তু পাশে যারা বসে আছে, তারা কেউ কারও মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। তাকানোর যেন কোনো ফুরসত নেই। তারা সবাই যে যার হাতের স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

এই তোমরা কী করছ—জানতে চাইলে মুখ না তুলেই দুজন বলল, ‘ফ্রি ফায়ার গেম খেলছি।’ আগের দিনের ছেলেরা বিকেলের এই সময় খেলার মাঠে থাকত। একদল খেলত, আরেক দল সেই খেলা উপভোগ করত। সেটাই ছিল রীতি।

ঈদে আনন্দ–আড্ডায় আর মেতে ওঠে না কিশোরেরা। সবাই মুঠোফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামে
ছবি :প্রথম আলো

এই বয়সী শিশু–কিশোরেরা স্মার্টফোন কেনার টাকা পেল কোথায়—জানতে চাইলে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিজ উদ্দিন বললেন, বেশির ভাগই মা-বাবাকে বাধ্য করেছে। বাধ্য হয়েই মা-বাবা কিনে দিয়েছেন। আবার কেউ নিজেরা কাজ করে টাকা জোগাড় করেছে। আরেকটা জিনিস হয়েছে, করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের নামে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা এখন এক জায়গায় বসে স্মার্টফোনে গেম খেলছে। বোঝা গেল, এরাই গ্রামের ঈদের সংস্কৃতি পাল্টে ফেলেছে। এই প্রজন্মের কাছে ঈদের অনুভূতি তাই এখন অন্য রকম।

আগে ঈদের শুভেচ্ছা দেওয়ার জন্য ঈদ কার্ড দেওয়া হতো। এখন আর সেই ঈদ কার্ডের চল নেই। এখন ঈদের শুভেচ্ছা দেওয়া হয় মুঠোফোনে খুদে বার্তায়। গ্রাম-শহর সব জায়গায় একই রেওয়াজ চালু হয়েছে।

ঈদের নামাজ পড়ার পর বন্ধুরা দলে দলে একজন আরেকজনের বাড়িতে যেত। খাওয়াদাওয়া-আড্ডায় চমৎকার সময় কাটাত। এখন আর এসব নেই।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র ঔড়ব রাজশাহী শহরে বাবা–মায়ের সঙ্গে থাকে । ঈদ উদ্‌যাপন করতে সে গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের দিনটি কাটানোর পরিকল্পনা করতে পারছে না। কারণ, তার বন্ধুরা যে যার কাজে ব্যস্ত।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঔড়ব বলে, তার বন্ধুদের একজন ঈদ উপলক্ষে বাঘা বাজারে দোকানে কাজ নিয়েছে। ঈদের দিন সে সময় দিতে পারবে না। আরেকজন সেনাবাহিনীতে চাকরির চেষ্টা করছে। সে সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত।

আগে ঈদের শুভেচ্ছা দেওয়ার জন্য ঈদ কার্ড দেওয়া হতো। এখন আর সেই ঈদ কার্ডের চল নেই। এখন ঈদের শুভেচ্ছা দেওয়া হয় মুঠোফোনে খুদে বার্তায়। গ্রাম-শহর সব জায়গায় একই রেওয়াজ চালু হয়েছে।

ঈদের দিনের সকালে গ্রামে গোসলের উৎসব হতো। সকালে পাড়ার সবাই একসঙ্গে পুকুরে গোসল করতেন। সবার হাতে সুগন্ধি সাবান থাকত। অনেক পরিবার সারা বছর এই সাবান কিনতে পারত না। ঈদের দিনের সকালের গোসলের জন্যই সাবান কেনা হতো। একজন মাথায় সাবান দিয়ে আরেকজনের হাতে ছুড়ে দিত। অন্য রকম ছিল সেই দৃশ্য। গ্রামে এখন ঈদের সকালে আর এই গোসল-উৎসব হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গ্রামের গোসল করার মতো কোনো পুকুরই নেই। যে কটি পুকুর অবশিষ্ট আছে, তার পানিতে গোসল করার অবস্থা নেই। মাছ চাষের জন্য পানিতে সার ও অন্যান্য জিনিস দেওয়া হয়। এতে পুকুরের পানি আর মুখে তোলা যায় না। কেউ গোসল করতেও পারেন না।

আবার ঈদের নামাজ শেষ করে গ্রামের সবার বাড়ির ফিরনি এক জায়গায় করে সবাই মিলে খেত। ঈদের দিনের সবাই একসঙ্গে ফিরনি খাওয়ার এই বিষয়কে মহোৎসব মনে করা হতো। এখন সেই উৎসবও আর নেই। নেই ঈদ উপলক্ষে কাছের ও দূরের মানুষের সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগ এবং একে অপরের বাড়িতে যাওয়ার রীতি।