বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানের হত্যাকারীদের বিচার চায় পরিবার

বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানের বাড়িতে শোকে স্তব্ধ তাঁর স্বজনেরা। সোমবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়
ছবি: প্রথম আলো

সাজ্জাদুজ্জামানের (৩০) মা উম্মে কুলসুম (৬৫) ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী। প্রতি মাসে ছেলের দেওয়া টাকায় তাঁর চিকিৎসা হচ্ছিল। গতকাল রোববার ছেলের মৃত্যুর খবরের পর থেকে তাঁর মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই কান্নাকাটি করছেন। মাকে রেখে কেন সাজ্জাদুজ্জামানকে আল্লাহ নিয়ে গেলেন, এগুলো বলে বিলাপ করে যাচ্ছেন তিনি।

আজ সোমবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালংয়ের হরিণমারা এলাকায় ডাম্পারের (মিনিট্রাক) চাপায় নিহত বন বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানের বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান (৭০)। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে হরিণমারা এলাকায় ফরিদ আলমের দোকানের সামনের সড়কে সাজ্জাদুজ্জামান ডাম্পারের চাপায় নিহত হন।

সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বন বিটের দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন বিভাগে যোগ দেন সাজ্জাদুজ্জামান। তিনি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ভবেরচর ইউনিয়নের ভিটিকান্দি এলাকার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে।

শাহজাহান বলেন, ‘রমজান মাসে প্রতি রাতে সাহ্‌রির সময় সাজ্জাদুজ্জামান আমাকে ফোন করত। ওর মা আর আমার সঙ্গে অনেক সময় নিয়ে কথা বলত। সংসার চালাত। মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাত। সর্বশেষ শুক্রবার কথা হয়েছিল। ওর মায়ের চিকিৎসার কথা বলেছিলাম। বলেছিল, কোনো চিন্তা যেন না করি। মাস শেষে বেতন পাওয়ামাত্র টাকা পাঠিয়ে দেবে। শনিবার আর কথা হলো না। সেদিন সাহ্‌রির সময় ফোন এল ঠিকই, সে ফোনে জানানো হলো, সাজ্জাদুজ্জামান আর নেই। তাকে মাটিখেকোরা মেরে ফেলেছে।’

সাজ্জাদুজ্জামান আড়াই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার মুমতাহেনা সুমিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে মাবির শাহ নামে ৯ মাস বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। সাজ্জাদুজ্জামানের মৃত্যুর পর থেকে অনেকটাই বাক্‌রুদ্ধ সুমি। তিনি দুই দিন ধরে কারও সামনে আসছেন না বলে জানান সাজ্জাদুজ্জামানের বড় ভাই কামরুজ্জামান।
কামরুজ্জামান বলেন, ‘সাজ্জাদুজ্জামান ছোট থেকেই পরোপকারী ছিল। অন্যায় মেনে নিতে পারত না। বিপদে কেউ ডাকলে রাত হোক কিংবা দিন, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেত। ঘটনার দিন সাজ্জাদুজ্জামানের সঙ্গে থাকা সহকর্মীর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, পাহাড় কাটার খবরে তাৎক্ষণিক মোটরসাইকেল নিয়ে ওই সহকর্মীসহ তারা ঘটনাস্থলে যায়। ওই সহকর্মী ফোর্সসহ যাওয়ার কথা বলেছিল। সাজ্জাদুজ্জামান বলেছিল, আগে তারা গিয়ে পরিস্থিতি দেখবে, পরে প্রয়োজন মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।’

কামরুজ্জামান আরও বলেন, ‘সাজ্জাদুজ্জামান তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আমরা হত্যার বিচার চাই। ওর বউ–বাচ্চার জীবন এখন কীভাবে চলবে! যদি ওর স্ত্রীর জন্য বন বিভাগে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে হয়তো ওদের জীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা ঠেকানো যেত।’

শনিবার গভীর রাতে হরিণমারায় পাহাড় কেটে ডাম্পারে ভরে বালু পাচার হচ্ছিল। খবর পেয়ে সাজ্জাদুজ্জামান বন বিভাগের গাড়িচালক মো. আলীকে (২৭) নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় বালু পাচারকারীরা ডাম্পার দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী সাজ্জাদুজ্জামান ও আলীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যান। এতে মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। আহত অবস্থায় চালক আলীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

গতকাল বাদ জোহর কক্সবাজার শহরে বিভাগীয় বন বিভাগের কার্যালয় প্রাঙ্গণে সাজ্জাদুজ্জামানের জানাজা হয়। এরপর স্বজনেরা লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার গ্রামের বাড়িতে আসেন। রাতে জানাজা শেষে দাফন করা হয় এই কর্মকর্তাকে।

এদিকে সাজ্জাদুজ্জামানকে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে গতকাল প্রধান বন সংরক্ষক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। চিঠিতে সই করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুলতানা কামাল, নিজেরা করি সংস্থার সমন্বয়কারী খুশী কবির, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।