‘পান থেকে চুন খসলেই’ পড়তে হয় জেরার মুখে

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া
প্রথম আলো ফাইল ছবি

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাফেটেরিয়ার একটি টেবিলে বসে কথা বলছিলেন তিন শিক্ষার্থী। পাশের দুটি চেয়ার খালি। অন্য একটি টেবিলে বসার জন্য সেখান থেকে একটি চেয়ার নিতে যান দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। যেন মহা অন্যায় করে ফেলেন তিনি। চেয়ার ধরতেই ধমক দিয়ে ওঠেন ওই টেবিলে বসা একজন। কোন বর্ষের শিক্ষার্থী তা জানতে চান। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুনেই একে একে তিনজনকে রিমান্ডের মতো করে বিভিন্ন জেরা শুরু করে দেন। বড় ভাইদের ওই আচরণে রীতিমতো ভড়কে যান দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

কয়েক দিন আগে পুরো ঘটনাটি ঘটে এই প্রতিবেদকের সামনেই। দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন ক্যাফেটেরিয়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। এটি অলিখিত নিয়মে পরিণত করেছেন বড় ভাইয়েরা। এমন আরও অনেক অলিখিত নিয়ম রয়েছে, যা মানতে বাধ্য করা হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। তবে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা শিথিল।

দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। বড় ভাইয়েরা ধরে নেন তাঁরা (প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী) বিশ্ববিদ্যালয়ের আদবকেতা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এ কারণে ‘পান থেকে চুন খসলেই’ জেরার মুখে পড়তে হয়। মানসিক নির্যাতন তো রয়েছেই, কখনো তা শারীরিক নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যায়। এসব বিষয়ে অভিযোগ করলে পরবর্তী সময়ে বড় ভাইদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এমনকি ওই বর্ষের সব শিক্ষার্থীকে ‘একঘরে’ করে রাখার মতো ঘটনাও ঘটে। ওই বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডিসিপ্লিনের কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। এ কারণে ব্যাপারটি মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের আরও অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা জানান, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার বিষয়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া প্রথম বর্ষের কেউ ফুলহাতা জামার হাতা গুটিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে পারবেন না। জামার বোতাম খুলে রাখা যাবে না। উচ্চ স্বরে কথা বলা যাবে না। চুল পরিপাটি করে রাখতে হবে। বড় ভাইদের সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাঁদের (বড় ভাই) দেখলেই সুন্দর করে সালাম দিতে হবে। বড় ভাইয়েরা যখন যা বলবেন, তখন তা মেনে নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা বলেন, এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেই বড় ভাইদের কাছে বড় ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়। বেশির ভাগ সময় তা হয় মানসিক নির্যাতন। কখনো আবার গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাও ঘটে। তবে বেশির ভাগ সময় শিক্ষার্থীরা তা মুখ বুজে সহ্য করেন। অনেকে সহ্য করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগের মাত্রা ঘটনার চেয়ে একেবারেই নগণ্য।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে গত ১৬ আগস্ট থেকে। এরই মধ্যে গত শুক্রবার রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. আমানউল্লাহকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন তাঁরই ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের তিন শিক্ষার্থী। আমানউল্লাহ অভিযোগ করেছেন, শুক্রবার বিকেলে ফুলহাতা জামার হাতা গুটিয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করেছেন তিনি। ওই ‘অপরাধে’ তাঁকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন তাঁরই ডিসিপ্লিনের বড় ভাইয়েরা।

এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই লিখিত অভিযোগে একই ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা তাঁদের (প্রথম সেমিস্টার) বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করেছেন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা। ওই মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শেষ হওয়ার পরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাসে আটকে রাখা, গালাগাল করা, বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করা ছাড়াও ক্যাম্পাসের ভেতরে কোথাও ডেকে নিয়ে হয়রানি করা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক শরীফ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে কারণেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘ওরিয়েন্টেশনের’ আয়োজন করা হয়। মাঝেমধ্যে প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাউন্সেলিং করা হয়। এরপরও এটা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।